তিন মাস হতে চললো এখন পর্যন্ত আমি স্বাভাবিক হতে পারি নাই, চোখের সামনে ওরা কি নির্মম, হিংস্র জানোয়ারের মতো আক্রমণ চালিয়েছে আমাদের ছাত্র জনতার উপরে, রাবার বুলেট, টিয়ার শেল, কাঁদুনে গ্যাস, ছাত্রলীগের হাতে রামদা, হকিস্টিক শেষের দিকে পিস্তল, রিভলবার সবকিছু ওরা ব্যবহার করেছে। এখনো মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ আঁতকে উঠি।
ফ্যাসিস্ট, খুনি হাসিনা সবধরনের মারণাস্ত্র ব্যবহার করেছে ছাত্র জনতার উপরে। আমি যে পুলিশ বাহিনীকে দেখেছি, এরা কি সত্যিই কি আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ ছিলো?
এদের হাতটা ইকটু বিন্দু পরিমাণ কাঁপল না? এইভাবে নিজের দেশের মানুষের উপর কেউ গুলি চালায়? এদের সন্তানও হয়তো আমাদের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল, বিবেকের তাড়নায়, কারণ যা চলছিল তা মেনে নেওয়ার মতো ছিলো না। আমাদের দাবি কি ছিল? দাবি ছিলো কোটার হার টা ইকটু কমানো। কমিয়ে দিলেই তো ছাত্র-সমাজ ঘরে ফিরে যেতো। কিন্তু খুনি হাসিনার প্ল্যান ছিলো অন্যকিছু, নিজে নিজে ডামি নির্বাচন করে পুনরায় ক্ষমতার সিংহাসন আরও দীর্ঘায়িত করার প্ল্যান ছিলো এই ফ্যাসিস্টের, এই খুনি চিন্তা করেছিলো আন্দোলন করতে থাকুক, কিছু লাশ ফেলে দিবো, সব বাসায় চলে যাবে। আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এই খুনি- গণহত্যাকারী ভুলে গেছিলো, এটা কোনো দলের আন্দোলন ছিলো না, এটা ছিল ছাত্রদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। আর ইতিহাস সাক্ষী ছাত্র আন্দোলন কোনোদিনও ব্যর্থ হয় নি, হবেও না। এই খুনি মনে করেছিল, লাশ কয়েকটা ফেলে দিলেই সবাই ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু সবকিছু হয়েছে উল্টা, লাশের সারি যত বাড়তে থাকল, আমাদের সংখ্যা দ্বিগুণ -তিনগুণ -চারগুণ এইহারে বাড়তে থাকলো। সারা দেশের ছাত্ররা মাঠে নেমে গেলো। বিভাগ, জেলা থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে এই অধিকার আদায়ের আন্দোলন। ঢাকা ভার্সিটি থেকে এই আন্দোলন শুরু হয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে গেছে, এই আন্দোলনের বজ্রধ্বনি। স্কুল, কলেজ,মাদ্রাসা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ কোনো প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঘরে থাকতে পারে নাই,সাথে সাধারণ মানুষ তো ছিলোই। নেটওয়ার্ক বন্ধ করে কি অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছিল,মনে করেছিলো নেটওয়ার্ক বন্ধ করলে হয়তো আন্দোলন থেমে যাবে, থেমে যায় নাই, আমরা শেষটা দেখার অপেক্ষায় ছিলাম, হাজার হাজার ছাত্র জনতার রক্ত যখন জড়েছে, গুলি চালিয়েছে মিছিলে হত্যা করেছে আমাদের ভাইদের-বোনদের এটা শেষ দেখে ছাড়বো আমরা। আমরা প্রথম দিকে ভয় পেতাম কিন্তু প্রতিদিন দেখতে দেখতে ভয়টা চলে গেছিলো। চোখের সামনে সবসময়ই যদি একটা জিনিস ঘটে, তখন এটা নরমাল হয়ে যায়। দেশের ছাত্র জনতাও এটা নরমাল ভাবেই নিতো, নিতো বললে ভুল হবে, খুনি এটা নরমাল বানিয়ে দিয়েছিল। আমরা যাঁরা আন্দোলন সংগ্রামে ছিলাম, আমরা প্রতিদিন মৃত্যুকে সালাম জানিয়ে ঘর থেকে বের হতাম, কারণ যেকোনো সময় একটা বুলেট এসে বুকে, মাথায় লাগতে পারে, মুহূর্তেই জীবন চলে যেতে পারে। একটা বুলেটই যথেষ্ট ছিলো।
হসপিটালে গেলে দেখা যায়, আমার ভাইয়েরা কিভাবে কাতরাচ্ছে হসপিটালের বেডে, কারও চোখ নেই, কারও পা নেই, কারও মাথায় গুলি, কারও বুকে গুলি,কারও পেটে গুলি, এখনো কয়েকদিন পর পর শোনা যায় চিকিৎসারত অবস্থায় শহিদ হইতেছে আমাদের ভাইয়েরা।আমার হাজার হাজার ভাই-বোন পঙ্গুত্ববরণ করেছে। ১৬০০+ শহিদ হয়েছে এই দেশের জন্য।
দেশ সংস্কারের শুরুতে এদের বিচার আগে করা উচিত,আমরা না হয় ডাল-ভাত খেয়ে কিছুদিন কাটিয়ে দিলাম, সমস্যা নেই, এদের কেউ যাতে আইনের হাত থেকে পালাতে না পারে। এদেরকে শুধু নিষিদ্ধ করলে হবে না।এদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। না হয় আমার শহিদ ভাই-বোনদের আত্মা শান্তি পাবে না। পঙ্গুত্ব বরণ করা আমার হাজার হাজার ভাই-বোনের আত্মা শান্তি পাবে না।
ইকটু সময় দেন এই বিপ্লবী সরকারকে (যদিও এই সরকারে বিপ্লবী সরকারের আচরণ পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়নি)। আগে গণহত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত হউক। পরে দেশের সব রাজনৈতিক দল বসে সিদ্ধান্ত নিন, কখন নির্বাচন দেওয়া যায়, সবাই সবার দিক থেকে সহযোগিতা করুন। গত ১৬ বছর অপেক্ষা করতে পেরেছেন, এখনো কিছু বছর অপেক্ষা করতে পারবেন। ক্ষমতা নিয়ে টানাটানি করতে গিয়ে সব নিজ হাতে শেষ করে দিয়েন না আপনারা।
হ্যাঁ,আমরা জানি একটা নির্বাচিত সরকার এই মুহূর্তে আমাদের খুবই দরকার ছিল, কিছুটা হুমকিতে রয়েছি আমরা এই দিক থেকে। কিন্তু এই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ছাত্রসমাজ সহ সব দল নিয়ে একটা “জাতীয় সরকার” গঠন করাটা খুবই দরকার ছিল। জানি না তাঁরা তাড়াহুড়ো করে কেন অন্তবর্তীকালীন সরকার এনেছেন। হয়তো ভালোর চিন্তা করেই।
যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন প্রতি-মুহূর্তে আমাদের সকলের সজাগ থাকতে হবে, ওরা একটার পর একটা প্ল্যানিং করে যাচ্ছে। ওদের সব প্ল্যান ধ্বংস করে দিতে হবে, যেভাবে ফ্যাসিস্টকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে ওইভাবে।
মহিদ হাসান শান্ত
নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ
আপনার মতামত লিখুন :