বর্তমান বাংলাদেশে রাজাকার, পাকিস্তানের পা চাটা, নাকি শাহাবাগী? আওয়ামী সমর্থকদের মুখরোচক গালি বা ব্যঙ্গ বিদ্রূপে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী রেজিম সকল সময় এটাই চেষ্টা করে সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বানাতে। আর এই কাজটা তারা তখনি খুব ভাল ভাবে করতে পারে। যখন তারা নিজেরা ক্ষমতায় থাকে। সরকারে থাকে।
আজকের সেই আওয়ামীলীগ করা অথবা সমর্থন করে সদস্যটিও অবলীলায় আরেকজনকে ‘রাজাকার’ বলছে । গণজাগরণ মঞ্চের যারা পরিচিত মুখ তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ ট্রল করছে। এরাই বলছে ‘বিকল্প নাই’। এই ছেলে/মেয়েটি তো দুরের কথা তার বাপ-মাও মুক্তি যুদ্ধ দেখে নাই, মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্কে সামান্যতম পড়াশুনাও নাই, বলেই তারা আওয়ামী রেজিমের খপ্পরে পরে এই কথাগুলি বলে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি গোষ্ঠীর হাতে বন্দি হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মেহমান হন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরামর্শে।
স্বাধীন বাংলাদেশে মুজিব নগরের সরকার প্রধান দেশে ফিরে শপথ নিয়েছিলেন কিনা সে প্রমাণ নাই। তবে প্রমাণ আছে সবার প্রথমে তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের প্রধানমন্ত্রী পদ কেড়ে নিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পরপর ১৯৭২ এর যে সংবিধান রচিত হল – সেই সংবিধানের ১৪৯ অনুচ্ছেদ বলে – “এই সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে সকল প্রচলিত আইনের কার্যকারিতা অব্যাহত থাকিবে, তবে অনুরূপ আইন এই সংবিধানের অধীন প্রণীত আইনের দ্বারা সংশোধিত বা রহিত হতে পারিবে।”
অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী (দুটি পদই উল্লেখ করা হল এই কারণে যে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ক্ষমতার পেছনে অক্লান্ত ভাবে দৌড়িয়েছেন এবং রাষ্ট্রপতি – প্রধানমন্ত্রী – রাষ্ট্রপতি –প্রধানমন্ত্রী এই দৌর দৌড়েছেন)। পাকিস্তানি সকল কালাকানুন পরিবর্তন করা তো দুরের কথা পাকিস্তান সহ ব্রিটিশ উপনিবেশিক ভারতের সকল আইন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে বহাল রেখেছেন।
অর্থাৎ কিনা যে আইনের বলে অপারেশন সার্চ লাইট খ্যাত অপারেশন দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আবাসিক হল সহ সকল আবাসিক ভবনে তাণ্ডব চালিয়েছিল, রাজারবাগে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল সেই আইনের বৈধতা দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সরকারের সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। এবং সেই অবৈধ আইন বর্তমানের বাংলাদেশে এখনও বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে আলাদা একটি ভয়ঙ্কর দানব হিসাবে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন’ নামে মানুষের সামনে হাজির হয়ে মানুষের চিন্তা করবার স্বাধীনতাও হরণ করেছে।
পাকিস্তান আমলে অন্তত চিন্তা করবার স্বাধীনতা মানুষের ছিল। অন্তত ১৯৫২ সালে শিক্ষার্থীরা এই চিন্তা করতে পেরেছিল যে তারা ৬/৪ জনের মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামবে এবং ১৪৪ ধার ভাঙ্গবে। ভেঙ্গেওছিল। নিশ্চয় সে সময় ঢাকা ভার্সিটিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাথে সাথে সকল গোয়েন্দা সংস্থা উপস্থিত ছিল এবং তারা অবগত ছিল শিক্ষার্থীদের সামনের কর্মসূচী কি?
যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনে কেবল আসামীদের অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীদের আপিল করবার সুযোগ ছিল কিন্তু সরকার পক্ষের আপিল করবার সুযোগ ছিল না। নিশ্চয় এই যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে জোট সরকার সেই সময়ে ক্ষমতায়, তাদের তত্ত্বাবধানে।
গণজাগরণ মঞ্চ গঠিত হয়েছিল – সরকার পক্ষের আপিল করবার অধিকার আদায়ের লক্ষে। অর্থাৎ আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে জোট যেন কোন ভাবেই যুদ্ধাপরাধীদের তাদের হাতের খেলার পুতুল না বানাতে পারে, বিচারের নামে জনগণের চোখে ধুলা দিবার প্রহসন না করতে পারে, সেই লক্ষকে সামনে রেখে। গণজাগরণ মঞ্চের অনেক ভুল হয়তো ছিল, সেটা সম্ভবও কারণ এটা কোন রাজনৈতিক দল ছিল না বরং বাংলাদেশের আপামর জনগণের দাবী ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং স্বেচ্ছায় কিছু তরুণ প্রথমে জমায়েত হয়েছিল শাহবাগে এই দাবীতে।
জনগণ যুদ্ধাপরাধের বিচার চেয়েছিল এবং গণজাগরণ মঞ্চ নামে একত্রিত হয়েছিল বলেই কি আজ আওয়ামী রেজিম গণজাগরণ মঞ্চ কে নিয়ে ট্রল করে? ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে?
রাজাকার কাহাকে বলিবেন?
যাহারা “প্রচলিত আইন” এর নামে সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে প্রচলিত আইনের ব্যাখ্যা দেয় এই ভাবে – “প্রচলিত আইন অর্থ এই সংবিধান-প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানায় বা উহার অংশবিশেষে আইনের ক্ষমতা সম্পন্ন কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সক্রিয় থাকুক বা না থাকুক, এমন কোন আইন।”
তাহাদের সহ ১৯৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তাহাদের? নাকি যারা আওয়ামী রেজিমের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠায় কথা বলে কাজ করে, তাহাদের রাজাকার বলিবেন?
আদীল হোসেন
লেখক ও বিশ্লেষক
আপনার মতামত লিখুন :