দেবেশ রায়ের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার


অনলাইন ডেক্স প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ৩০, ২০২১, ৬:২৯ পূর্বাহ্ন
দেবেশ রায়ের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

গত ১১ এপ্রিল, ২০১৫, পহেলা বৈশাখ ১৪২২ উপলক্ষে কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায় ঢাকায় এসেছিলেন। অতিথি হয়েছিলেন ‘জেমকন সাহিত্য পুরস্কার’ প্রাপ্ত ঔপন্যাসিক সালমা বাণীর নিকুঞ্জের বাসায়। এই সাক্ষাৎকারটি ১২ এপ্রিল গ্রহণ করা হয়। মুনিরা সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি ‘দেবেশ রায়ের উপন্যাসে জীবনের অন্তর্বয়ন’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন।
প্রশ্ন : তত্ত্ব বিভ্রান্ত করে না, বরং শক্তি জোগায়, উপন্যাসের তত্ত্ব বিষয়ে এই মতাদর্শে কি আপনি বিশ্বাস করেন?

দেবেশ রায় : প্রশ্নটি অতিরিক্ত ক্যাটাগরিক্যাল। নিশ্চয়ই তত্ত্ব শক্তি যোগায়। উপন্যাস সম্পর্কে যে তাত্ত্বিক ধারণা, তা বাংলা উপন্যাসকে একটা সময় পর্যন্ত সাহায্য করেছে। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রকে করেছে, রবীন্দ্রনাথকে খুব একটা করেনি, শরৎচন্দ্রকে কিছুটা করেছে। তারপর ‘কল্লোল—কালিকলম’ থেকে শুরু করে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী প্রমুখ ঔপন্যাসিককে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। তবে উপন্যাস সম্পর্কে পৃথিবীতে যত তত্ত্বের আবির্ভাব হয়েছে, তার সবটা একজন ঔপন্যাসিকের পক্ষে জানা বা ধারণ করা সম্ভব নয়। তত্ত্ব জেনে গেলে তখন এর একটা আধিপত্য তৈরি হয়। ‘এইটা হল উপন্যাস’—এই নিরিখে সমালোচকেরাও তখন বিচার করেন। পশ্চিমা বেশ কিছু আধিপত্যশীল তত্ত্ব আমাদের উপন্যাসকে প্রভাবিত করেছে। এটাকে আমি বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক ক্ষতি হিসেবে দেখি। বাংলা সাহিত্যে তত্ত্বের বাইরে থেকে যাঁরা উপন্যাস লিখেছেন, তাঁরা ঔপন্যাসিক হিসেবে মর্যাদা পাননি। হুতোম প্যাঁচার নকশাকে উপন্যাসের প্রথম চেষ্টা বলে আখ্যায়িত করা হয়। এটা যদি আমাদের প্রথম উপন্যাস হয়, তাহলে বলতে হবে, আমরা নিজেদের মতো উপন্যাসের একটা মডেল তৈরি করেছিলাম। কিন্তু তাত্ত্বিক-সমালোচকেরা তা ধরতে পারেননি। বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী সম্পূর্ণ পাশ্চাত্য আঙ্গিক-অনুসারী উপন্যাস, যদিও এ নিয়ে ভিন্ন মত আছে। আর পাশ্চাত্য মডেল যখন আমাদের উপন্যাসে প্রয়োগ করতে পারলাম, তখন স্বীকৃতিও মিলল—হ্যাঁ, এটা উপন্যাস হয়েছে। তাহলে তত্ত্ব বিভ্রান্তও করে! তত্ত্বের প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে। তত্ত্বটা ঔপন্যাসিকের স্বভাবের ওপর কীভাবে কাজ করে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন— একজন লেখক কী লিখবেন, সেই গল্পটা জানেন, এ পর্যায়ে যদি কোনো তত্ত্ব তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে, তাহলে ঔপন্যাসিক উপন্যাস বা গল্পটাকে একটা মডেলে রূপ দেন। বঙ্কিমচন্দ্র দুর্গেশনন্দিনী লিখে অনেককে সেটা পড়ে শুনিয়েছিলেন এবং জিজ্ঞেস করেছিলেন ভাষার কোনো গোলমান আছে কি-না। কেউ বললেন, ‘দু’এক জায়গায় আছে, কিন্তু গড়পরতা সুন্দর হয়েছে।’ কিন্তু কপালকুণ্ডলা উপন্যাসটিকে আমি বলব এটা একেবারে মাটি থেকে উঠে আসা উপন্যাস। লাতিন আমেরিকার সূত্রে ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ নামে যে শব্দটা আমরা পেয়েছি, কপালকুণ্ডলা’য় তার সবটাই দেখা যায়। তবে সেটা খুবই মৌলিক, তত্ত্বও সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র দুর্গেশনন্দিনী, মৃণালিনীর পরে এই জায়গায় পৌঁছুতে পেরেছেন। আবার তিনি আলালের ঘরের দুলাল বাহুতোম প্যাঁচার নকশাকে উপন্যাস ভাবতেন না। একটা প্রবন্ধে আমি এটার খুব নিন্দা করেছি। আমি দৃঢ়ভাবে মনে মনে করি, হুতোম প্যাঁচার নকশা আমাদের প্রথম উপন্যাস, তা সত্ত্বেও আমি এটাও মনে করি, এটা আমাদের উপন্যাসের মডেলটাকে ঠিক জায়গায় আনতে পারেনি। সেই জায়গায় যেন মধুসূদনকে দরকার ছিল। আবার ভারতচন্দ্রকে অস্বীকার না করলে মধুসূদনের মহাকাব্য লেখা হত না। বঙ্কিমচন্দ্রও হুতোম প্যাঁচার নকশাকে উপন্যাস মনে করেননি এবং উপন্যাস লিখেছেন। তাই সব মিলিয়ে বলব, তত্ত্ব যেমন বিভ্রান্ত করে, তেমনি আবার সাহায্যও করে। নতুন উপন্যাস থেকে তৈরি হয় নতুন তত্ত্ব। সেই তত্ত্বটা আবার উপন্যাসকে ব্যাখ্যা করতে থাকে। যেমন—মার্কসবাদীরা লুকাচের তত্ত্ব দিয়ে বিচার করে। আমাদের বাংলা উপন্যাসে নতুন তত্ত্ব তৈরি হওয়াটা বিরল। হয় পাশ্চাত্য মডেল চর্চা, না হয় অন্যের অনুকরণ চলে। উপন্যাস সম্পর্কিত নতুন তত্ত্ব সৃষ্টি হওয়া খুবই দরকার। বাংলা উপন্যাসের জন্য আমি সেটাই মনেপ্রাণে কামনা করি।

প্রশ : উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদে আপনি লিখেছেন, ‘আমি এমন একজন উপন্যাসিকের শিল্প-সংকটের কথা ভাবছি যে আজ বা আগামীকাল চাইতে পারে—সে যে-বাক্যটি রচনা করবে আর সেই বাক্যের ভিতরে যে অর্থটি ভরে দিতে চাইবে তার মাঝখানে একমাত্র সংযোজক হিসেবে সেই থাকবে লেখক হিসেবে, কথক হিসেবে; সে কোনো কলোনির প্রজা হিসেবে কলোনির কোনো শিক্ষা তার বাক্যের ভিতরে ভরে দেবে না। আমি এমন একজন ঔপন্যাসিকের কথা ভাবছি যে আজ বা আগামীকাল চাইতে পারে—সে স্বাধীন, তার লেখা স্বাধীন ও সেই লেখায় নিহিত অর্থও স্বাধীন।’—এই বক্তব্যটিকে কি উত্তর-উপনিবেশবাদী বলে আখ্যা দেয়া যায়?

দেবেশ রায় : না। উত্তর-উপনিবেশবাদী তত্ত্বটি অনেক বেশি কংক্রিট, অনেক বেশি আইডেন্টিফায়ারেবল, অর্থাৎ চিহ্নিত করা যায়। বইটি থেকে যতটা আপনি উদ্ধৃত করেছেন, সে বক্তব্যে একটা অভিমান রয়েছে। সেটা হল—আমাদের ঔপন্যাসিকেরা বিদেশ দ্বারা ভীষণ প্রভাবিত। বিদেশে চর্চিত কোনো মতবাদ, উপন্যাসের কোনো ফর্ম বা কনটেন্ট অধিকাংশই পুরনো হয়ে যাওয়ার পর আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়। উদাহরণ হিসেবে ‘ম্যাজিক রিয়ালিজমে’র কথা বলা যায়। এ প্রসঙ্গেই আমি মনে করিয়ে দিতে চাই—আমাদের ‘মঙ্গলকাব্য’ হলো আমাদের উপন্যাসের প্রধান আদর্শ। মঙ্গলকাব্যগুলোতে যে ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি হয়েছে, তার আধুনিকায়ন হয়নি। এইটা হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় ‘হিস্টরিক্যাল ল্যাপস’। ঐ ন্যারেটিভ প্যাটার্ন যদি রিভাইস করা যেত তাহলে খুবই ভালো হত। এখন এই ব্যাপারটা আমি তত্ত্বাকারে বলি বলে কেউ জিজ্ঞেস করতে পারেন যে, তাহলে আপনি কি আপনার উপন্যাসে তা-ই করেছেন? আমার উত্তর- না আমি করিনি। আর আমি করিনি মানে আমি করতে পারিনি তাই করিনি। ইংরেজরা যদি এদেশে না আসত, তাহলে আমাদের উপন্যাসের প্রোটোটাইপ যেটা, সেটা আমাদের মঙ্গলকাব্য, পাঁচালি, লোককাব্য এবং বিভিন্ন কেচ্ছার মধ্য দিয়ে আসত। কালক্রমে ঐ ভঙ্গিটাই হয়তো মডার্নাইজড হত। ধরুন, আমার ভীষণ ইচ্ছে বিদ্যাসুন্দর নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতে, কিন্তু আমি পেরে উঠব না। অথচ এগুলো থেকে আমাদের নিজেদের উপন্যাসের একটা ফর্ম তৈরি হতে পারত। ঐতিহাসিকভাবেই এ ক্ষেত্রে আমাদের একটা পশ্চাৎপদতা তৈরি হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ, অদ্বৈত মল্লবর্মণ কেউই দেশজ ফর্ম তৈরি করতে পারেননি। কিন্তু তাঁরা সফল উপন্যাস লিখেছেন। বাংলাদেশের শাহীন আখতারের একটা উপন্যাস দেখেছিলাম সখী রঙ্গমালা। এছাড়া কলকাতার একজন লেখকের উপন্যাস ধনপতির গঙ্গাযাত্রা, ধনপতির সমুদ্রযাত্রা এই লেখাগুলোতে এক ধরনের চেষ্টা আছে, যেটাকে restoration of older form বলা যায়। সেলিম আল দীন-এর নাটকগুলোতেও এটা দেখা যায়। তাঁর নাটকের গদ্যকে চিহ্নিত করলে ওগুলোকে আসলে নাটক বলা যায় না। ন্যারোটিভলি লিখে গেছেন তিনি। আমার উপন্যাস নিয়ে বই প্রসঙ্গে সেলিম আমাকে বলেছিলেন যে তিনি ওই প্রবন্ধগুলোতে একটা তত্ত্ব খুঁজে পান। হতে পারে তিনি ওখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এরপর উনি ওনার ফর্ম তৈরি করে দিয়েছেন। নাটকে সেলিম সাফল্যের সাথে পৌরাণিক প্রসঙ্গ বা আমাদের মধ্যযুগীয় বহু সাহিত্য-উপকরণ ব্যবহার করেছেন। এই প্রসঙ্গেই আমি বলতে চাই যে ‘মধ্যযুগ’ শব্দটাকে আমি একটু গোলমেলে ও অনৈতিহাসিক মনে করি। আমাদের কোনো মধ্যযুগ নেই। আমাদের রয়েছে প্রাগ্-ব্রিটিশ ও ব্রিটিশ-পরবর্তী এই দুই পর্ব। যা হোক, সেলিম আল দীনের মতোই অনেক শিল্পকর্মের মাধ্যমে ‘আইসোলেটিভ’ চেষ্টা হয়েছে যেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ওগুলো আমাদের সাহিত্যের মূলধারার মধ্যে আসে না। আমার মনে হয় না আর আসবে। অমিয়ভূষণ মজুমদারের চাঁদবেনে উপন্যাসটির কথাই ধরুন, এতে উনি এরকম একটা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পরে মিশে-টিশে গেছে, ফর্মটা আর দাঁড়ায়নি। কিন্তু এই restoration of older form -ই হচ্ছে Indigenous Bengali form, আরও ভালো করে বললে Indigenous pre-British narrative form । এটাই restoration এবং এটার খুব বেশি চেষ্টা হয়নি। আমার আফসোস, আমাদের ঔপন্যাসিকেরা আমাদের দেশের ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠেন না কেন? বিদেশি ফর্মের চর্চায় হয়তো আপত্তি নেই, কিন্তু আমার সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকে যে উপন্যাসটা তৈরি হয়ে উঠছে না, সেটা তো আমার উপন্যাস না! তাই উপন্যাসের তত্ত্ব প্রসঙ্গে আমি সাম্রাজ্যবাদী। বাংলার উপন্যাস বাংলার মতো হবে। আমাদের কত রকম বৃষ্টিপাত, কত রকম জল আমাদের, এগুলোর কথা না এলে সেটা কী করে আমাদের উপনাস হবে!

প্রশ্ন : আপনি কি বিষয়বস্তুর কথা বলছেন, নাকি উপন্যাসের ফর্মের কথা বোঝাচ্ছেন? ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষের সাহিত্যচর্চায় উপন্যাস (Novel) নামক সাহিত্য-ফর্মটিকে যদি উপনিবেশের দান বলি, তা হলে ভুল হবে কী?

দেবেশ রায় : ফর্ম এবং কনটেন্ট দুটো আলাদা বিষয় নয়। ফর্মটাই বিষয়। ব্রিটিশ উপনিবেশে ভারতে পাশ্চাত্য সাহিত্যরূপের পঠন-পাঠন ও চর্চার ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করছি না আমি। উপনাসের ফর্ম এবং বিষয়বস্তু যে আলাদা এই ধারণাটাই ভুল। এই concept-টা মার্কস-লুকাচ করেছেন এবং বুর্জোয়া তাত্ত্বিকেরাও করেছেন। কোনো শিল্পকর্মের ফর্মটাই তার কনটেন্ট হয়ে যায়। আজকাল বিস্মিত হয়ে লক্ষ করি কোনো কোনো সমালোচনায় কোনটা কত পৃষ্ঠার উপন্যাস তারও উল্লেখ থাকে; উল্লেখ থাকে—এটা ক্রাউন/রয়েল/ডিমাই সাইজের এত সংখ্যক পৃষ্ঠার উপন্যাস! একজন সমালোচক ঠাট্টা করে বলেছেন যে, উপন্যাস এবং ছোটো গল্পের পার্থক্য করব কী করে! তিনি এ দুটোর পার্থক্য বিষয়ে বলেছিলেন যে ‘উপন্যাসে form determines the name; আর গল্পে name determines the form ।’ এই ধরনের কথায় আসলে ফাঁক থাকলেও আমি একে কিছুটা ঠিক মনে করি। যেমন ‘দ্বাদশ নভেলা’র ভূমিকায় আমিও বলেছি যে ৮০-৯০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত উপন্যাসকে নভেলা বলা যেতে পারে। কিন্তু ৮০-৯০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তারের উপন্যাসও তো হতে পারে। একজন রুশ ঔপন্যাসিক ও সাহিত্য বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন যে, ‘যেগুলোতে অনেক তর্ক-বিতর্ক কথাবার্তা থাকে সেগুলোকে উপন্যাস বলে! আর যেগুলোতে তা থাকে না সেগুলো নভেলা।’ কথাটা তো ঠিক নয় তাই না? ‘দ্বাদশ নভেলা’র ভূমিকায় আমি আরও বলেছি যে যেখানে উপকাহিনি প্রধান কাহিনিকে সাহায্য করছে না, প্রধান কাহিনিটি ইনডিপেনডেন্ট সেটা নভেলা, আর যেখানে প্রধান কাহিনিটা ছড়াচ্ছে, ছড়িয়ে উপকাহিনি দিয়ে আবার ফিরে আসছে সেইটা নভেল। এই কথাটায়ও ফাঁক আছে। কিন্তু আমার কাছে কথাটা অনেক গ্রাহ্য মনে হয়েছে।

প্রশ্ন : উপন্যাস আসলে কোনটি বা কীসের প্রতিনিধিত্ব করে? এটা কী? representation of reality নাকি documentation of reality?

দেবেশ রায় : দুটোর মধ্যে খুব একটা তফাৎ নেই। বাস্তবতা বা reality-টা হলো বেসিক ইলেমেন্ট, তার ওপর একটা স্ট্রাকচার তৈরি হয়। অভিজ্ঞতার অনেক রকমের ব্যাখ্যা হতে পারে। শিল্পীর সত্যিকার অভিজ্ঞতা আছে কি-না সেটা খুব জরুরি। যেমন চাষ করলেই চাষ সম্পর্কে জানা যায় না। অর্থাৎ অভিজ্ঞতাটা আর্টিস্টিক একসপিরিয়েন্সের মধ্যে আসছে কি-না সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে আমি একটা শব্দ ব্যবহার করি যা বাংলায় পড়েছি বলে মনে নেই, তা হলো ‘experencing’। অর্থাৎ ‘experence’ শব্দটাকে noun হ হিসেবে না নিয়ে verb হিসেবে নিচ্ছি। reality-কে আমি কীভাবে ব্যবহার করছি সেটাও বোঝা দরকার। যেমন—এরকম হতে পারে যে reality-কে বর্ণনা করতে করতে ওটা surreal হয়ে গেল। এই ব্যাপার আমার নিজের লেখায় খুব চলে আসে। আবার ধরুন, reality-র এমন বর্ণনা যে, পাঠককে bore করে দেয়া। খুব detail-এ কাজ করি বলে সমালোচক মহলে তো আমার বদনামই আছে। প্রতিটা ব্যাপারেই detail, detail-এ যাওয়া! কিন্তু detail ছাড়া তো reality হয় না! এরকম detail-এ বর্ণনা করতে করতে পাঠক যখন bore হয়ে যাচ্ছে তখন একটা surreality সৃষ্টি করা। অর্থাৎ রিয়েল-টাকে আনরিয়েল বা সুররিয়েল করে দেয়া। এটা আমার প্রতিবেদন উপন্যাসগুলোতে এবং আরও অনেক লেখায়ই আছে। বলতে পারেন এটা আমার একটা artistic habit। সুতরাং basic experience in reality হলো জরুরি। তবে মুশকিলটা হল এই যে, সাহিত্য-শিল্প শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি-নির্ভর শিল্প। কোন লেখকের কোন ক্ষমতা তা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে তফাৎ হয়। রবীন্দ্রনাথ যেমন বিনয় করে বলেছিলেন—

মাঝে মাঝে গেছি আমি ওপাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে

ভেতরে প্রবেশ করি সে সাধ্য ছিল না একেবারে।

আসলে জগতকে দেখার চোখ তো তাঁর একটা ছিল না! চারদিক থেকে দেখতে পাওয়া এবং বিপুল perception নিয়ে সৃষ্টি করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ : বিপরীতের বাস্তব আমার এই বইটা পড়বেন, সেখানে আমি তাঁকে উত্তর-উপনিবেশবাদী গল্প-লেখক বলেছি। আমার উপন্যাস চিন্তা তিনটি বইয়ে রয়েছে, এগুলো হল—মানিক : নিরবধি দেশ, তারাশংকর : নিরন্তর দেশ এবং রবীন্দ্রনাথ : বিপরীতের বাস্তব।

প্রশ্ন : উপন্যাস-সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আপনার মত জানতে চাইব। সাহিত্য-সমালোচনার তো বিভিন্ন তত্ত্ব, মতাদর্শ রয়েছে। যেমন সাহিত্যের শ্রেণিভিত্তিক সমালোচনা (Genre Criticism), রূপবাদী সমালোচনা (Formalist approach of Criticism), বিষয়বস্তু অনুসন্ধানী বিচার/বস্তুবাদী সাহিত্য-বিচারভঙ্গি ইত্যাদি। উপন্যাস-সমালোচনা কেমন হওয়া উচিত?

দেবেশ রায় : এগুলোর সবগুলো দৃষ্টিভঙ্গিই সঠিক। কিন্তু আমাদের দেশে হয় গল্পভিত্তিক না হয় বিষয়বস্তুর আলোচনা হয়। উপন্যাসের রূপবাদী সমালোচনা (Formalist Approach of Criticism) হয় না বললেই চলে। এটা এখন বেশি বেশি হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। তবে আপনি যদি সাধারণভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে বলব সব রকমের অ্যাপ্রোচেই সমালোচনা হওয়া ভালো। আমার কাছে অবশ্য সমালোচনার কিছু ব্যাপার বিরক্তিকর মনে হয়। যেমন—উপন্যাসে তো সমাজবাস্তবতা থাকবেই, কিন্তু কোনো কোনো সমালোচক কেবল ঐ সমাজবাস্তবতাটুকুই ‘কোট’ করে নিয়ে সমালোচনা করতে থাকেন। পাঠককে গল্পটা জানতেই দেন না। তবে উপন্যাসটা তো আর হাওয়ায় হয় না। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক, ঘটনা কী করে ব্যক্তি সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করছে এসব বিচার করাও গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন : সাধারণভাবে সময় ও সমাজ বাস্তবতা অনুযায়ী শিল্প তার স্বরূপ পেয়ে যায়, সেই সূত্রে উপন্যাসকেও কি তার স্বরূপ অনুসারে সমালোচনা করা উচিৎ নয়?

দেবেশ রায় : কোনো তত্ত্বের নির্দিষ্ট কাঠামো বা hypothesis-এর মধ্যে একটা শিল্পকর্মকে ফেলে দিলে এর পুরো বিচারটা হয় না। উপন্যাসের ক্ষেত্রেও তাই। যেমন আমাকে যদি চতুরঙ্গ উপন্যাসের ওপর লিখতে বলা হয়, তাহলে আমি অনুসন্ধান করব কোন জায়গাটা লেখা হয়নি, এটাকে সাইলেন্সের পার্ট বলতে পারেন। উপন্যাস এমন একটা শিল্পরূপ, যেখানে প্রত্যেকটা উপন্যাস উপন্যাসের নতুন ফর্ম তৈরি করে। যত insignificant উপন্যাস হোক, উপন্যাসের কোনো বাধা-ধরা ফর্ম নেই। ফর্ম হিসেবে উপন্যাসের মাহাত্ম্যই এই জায়গায় যে প্রত্যেকটা নতুন উপন্যাস, উপন্যাসের নতুন ফর্ম। সেটা ভাল বা খারাপ হতে পারে, ঔপন্যাসিক যেভাবে তাঁর ন্যারোটিভকে ধরছেন, তার ওপরেই ঐ উপন্যাসের ফর্মটা আকার নিচ্ছে। আর সেই আকারটাই হল উপন্যাস। উপন্যাসের আয়তনের কারণে এই ফর্মটা ভীষণ determining। আকার যেটা নিচ্ছে, সেই আকারটাই বিষয়। উপন্যাস এমন একটা শিল্পরূপ, যেখানে প্রত্যেকটা উপন্যাস উপন্যাসের নতুন ফর্ম তৈরি করে। কুমোর যেমন আঙুলে মাটির হাড়ির আকার ঠিক করে এই ব্যাপারটিও তেমন-ই। মাটির তাল-টা তো কনটেন্ট নয়, আঙুলে কুমোর তৈরি করছে আকার। যেটাকে কনটেন্ট বলা যায়। আমার সাহিত্য চিন্তা 2021-01-30 06:29:31

ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন: