সরকারি দল, সরকার ও রাষ্ট্র এক হয়ে গেছে – ফাইজ তাইয়েব আহমেদ


অনলাইন ডেক্স প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ৩০, ২০২১, ৬:২৯ পূর্বাহ্ন
সরকারি দল, সরকার ও রাষ্ট্র এক হয়ে গেছে – ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

বাংলাদেশের অধিকাংশ একাডেমিক এবং বাম বুদ্ধিজীবীরা যখন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেন তখন তারা যেন বিশ্বজয় করতে নামেন। চীন, জাপান, এমেরিকাকে আলোচনায় এনে হুলুস্থুল লাগিয়ে, বিস্তৃত পরিসরে, বিশাল আঙ্গিকে, বহুমুখী দৃষ্টিতে দেখাতে চান উনারা খুব জ্ঞানী। সমস্যার সঠিক কোন সমাধান দিতে পারেন না, একাডেমিক আলোচনার নামে অশ্বডিম্ব প্রসব ছাড়া। ফলে সরকারও ইনাদের কাছ থেকে পিক করার মত কোন আইডিয়া খুঁজে পায় না। দিনশেষে টেকনোক্র্যাট আর আমলারাই শেখ হাসিনার শেষ ভরসা।

বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যে বৈষম্যপুর্ণ অবকাঠামোগত ক্ষত গুলো তৈরি হয়েছে এগুলা বুঝতে এদেশের ফর্মাল বুদ্ধিজীবীরা নিতান্তই অক্ষম। ফলে তারা রাজনৈতিক সম্পর্ক ও অর্থনীতির সম্ভাবনা ও ঝুঁকির ফিউচার রিড করতে পারে না। বিশ্বমিডিয়ায় প্রকাশিত অন্য লোকের বিশ্লেষণই ইনাদের বুদ্ধির থলে।

ভারতকে একতরফা সুবিধা দেয়ার যে একচেটিয়া সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, এটা করেছে বর্তমান রেজিম। আগের সরকার গুলো বাধ্যহয়ে হয় গোপনে ভারত বিরোধিতা করে সমানে ভালো থাকার চেষ্টা করেছে নয়ত যতটা না দিয়ে পারা যায় এমন নীতিতে চলেছে, এভাবে চলতে গিয়ে কেউ কেউ ধরাও খেয়েছে। ২০০৯ এর আগের কোন সরকারই একতরফা দেয়ার এমন হীন্মান্য বৈষম্য তৈরি করেনি, যা বর্তমানে বিরাজ করছে। এটা সুপ্রতিষ্ঠ যে, ১/১১ এর পরের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরাশক্তি হয়ে উঠা ভারত বাংলাদেশে তার গোলাম সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের উপর প্রভাব বিস্তার করে। ফলে সে যা চাইছে, তাই তাকে দিতে হচ্ছে। ১২ বছরের টানা কর্তিত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শাসনের পরে বাংলাদেশে এখন সরকারি দল সরকার ও রাষ্ট্র এক হয়ে গেছে। রেজিমের সমস্যা রাষ্ট্রের সমস্যা হয়ে গেছে।

কিন্তু আরো বড় সমস্যা হচ্ছে, হয়ে যাওয়া চুক্তি গুলোকে ভবিষ্যতে বাতিল করার রিস্কে যাবে না কোন সরকারই। বড়জোর চুক্তি কাগজে রেখেই সে গুলা না মানার সংস্কৃতিতে যেতে হবে কথিত দেশপ্রেমিক সরকারদের, এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাইলেও। মিন্টাইম ইকোনোমি খুব স্ট্রং হলে; সরকার নির্বাচিত ও জবাদিহী হলে; পানি, সীমান্ত হত্যা, বন্যা, সমতা ভিত্তিক ট্রানজিট ইত্যাদি অর্থনৈতিক, অবকাঠামো ও নিরাপত্তার ইস্যু ভিত্তিক সামাজিক আন্দোলন দাঁড়া করাতে পারলে, কিছু বিষয়ে ভারতের সাথে রিনেগোসিয়শানের স্কোপ তৈরি করা যাবে। তবে মনে রাখতে হবে ভারত বিরোধী আন্দোলনকে ধর্মীয় রূপ দেয়া চলবে না অর্থাৎ ভারত বিরোধী আন্দোলন হিন্দু বিরোধী হবে না, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আন্দোলন হবে না। হবে জনতার আন্দোলন। হবে বিষয়ভিত্তিক অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত বিষয়ে আন্দোলন, নিরাপত্তার বিষয়ে, সীমান্ত হত্যা সহ সম্মানের বিষয়ে আন্দোলন- এমনভাবে যাতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা এর সুফল না নিতে পারে।

অর্থাৎ প্রথমে সামাজিক চাপ এবং এর উপর ভিত্তিক করে পরে রাজনৈতিক চাপ তৈরি করে বৈষম্যপূর্ণ চুক্তি গুলোকে ডিএক্টিভ করে রাখার কৌশলেই যেতে হবে। এর বিপরীতে রেজিম চেঞ্জ হলেই চুক্তি চেঞ্জের যে ডোনাল্ড ট্রাম্প মডেল আছে; আমি মনে করি, বাংলাদেশে এমন কোন মেরুদন্ড সম্পন্ন রাজনৈতিক দল নেই, যারা এই মডেলে যেতে পারবে। ফলে আগামীর দিনে রি-নেগোসিয়েশানের মোক্ষম সুযোগ খোঁজাই বাংলাদেশের মূল কাজ।

অর্থাৎ রিজিয়নাল পারস্পেক্টিভ অনুকূলে আসলে কূটনৈতিক/সামরিক/পররাষ্ট্র নীতি গুলোকে বৃহৎ পরিসরে না এনে বিষয় ভিত্তিক ইসুতে রি-নেগোসিয়শান চালাতে হবে। একটার পরে আরেকটা। এটা মনে করার কারণ নেই যে, ভারত নিকট ভবিষ্যতে দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যাবে। তাই সব বিষয় একসাথে তুলে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মত লেজেগোবরে পাকানোর কোন দরকার নাই। বরং বৈষম্য ও সমস্যা গুলোকে ইচ্ছায় বা ইনিচ্ছায় হোক, বাইলেটারাল এনগেইজমেন্টে গিয়েই সমাধান করতে হবে। তার জন্য একটা একটা করে মোক্ষম সময় খুঁজতে হবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই নেগোসিয়েশানের এলিমেন্ট গুলো ভারতের কাছে তুলে দিয়েছে। তার হাতে এখন কিছুই নেই বলতে গেলে। বরং শেখ হাসিনাকে একটি বুলেট তাড়া করার সার্বক্ষণিক ভয় দেখিয়ে কিংবা নিজেরা তৈরি করে সুবিধা হাতিয়ে নেয়াই ভারতের মূল কৌশল।

আমাদের মনে রাখতে হবে চীন বা এমেরিকা এসে ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক ঠিক করে দিয়ে যাবে না। ভারত এমন একটা দেশ যে তার দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে ৩য় পক্ষের ইনভল্ভেমেন্টে চরমভাবে নারাজ। বিষয়ভিত্তিক বৈষম্যের এলিমেন্টকে বের করে এনে, স্ট্যাডী করে পয়েন্ট টু পয়েন্ট সমস্যা আইডেন্টিফাই করে, সব তথ্য, উপাত্ত, প্রস্তাবনার কৌশল রেডি করে, প্রায়োরিটি অর্ডার ঠিক করে- মোক্ষম সময়ের জন্য বা সুসময়ের জন্য তৈরি থাকতে হবে। আমি মনে করি, এরকম একটা সময় ঠিক এখন যাচ্ছে।

ভারত-চায়নার মত শক্তিশালী বিবদমান পক্ষ গুলোর মধ্যে টেনশন থাকায়, সরকারের নেগোসিয়েশান কৌশলে কিছু সুবিধা এসেছে বলেই মনে করি, বাংলাদেশের দাবীকে ভারত আগের যে কোন সময়ের চাইতে বেশি পাত্তা দিতে বাধ্য। এদিকে নিকটতম সময়ে কোন নির্বাচনও নাই দেশে।

কিন্তু সমস্যা তিনটি-

১। জনপ্রনিধিত্ব মূলক নির্বাচিত সরকার নাই। ফলে সে নিজের ক্ষমতার কফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে ভারতকে খেপাবে না হয়ত।

২। অনির্বাচিত ও জনপ্রতিধিত্বহীন সরকার ও তোষামুদে আমলাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা এখন জিরোর কাছাকাছি। প্রশাসনে ভারতীয় প্রভাব এত ব্যাপক যে প্রায় সব কিছুই লীক হয়ে যায়।

৩। প্রশাসন ও নেতারা ভারতীয় ঠিকাদারি পক্ষ গুলো থেকে বেনিফিটেড।

এমতাবস্থায়, গণপ্রতিনিধিত্বের বিকল্প নাই। শেখ হাসিনা যদি নাগরিকদের সাথে নিয়ে এই সুপথে না হাটেন তবে চীন ও ভারতের দুই নৌকায় পা দেয়া তাঁর জন্য বড়ই বিপদ তৈরি করতে পারে! আলামতগুলো আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি।

2021-01-30 06:29:31

ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন: