নিশ্চয়ই জনগণ হারে নাই বা জিতে নাই। জনগণের অবস্থান অপরিবর্তিত আছে। সত্য বলতে কি বাংলাদেশের জনগণ লড়াই নেমে জিতে না এই অর্থে যে, তারা লড়াই নেমে জিতলেও শেষ পর্যন্ত হেরে যায়। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের জনগণ সশস্ত্র বিপ্লবে নেমেছিল। জিতেছিল। জনগণের এই জয় টা ছিল এই অর্থে যে তারা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছিল। এই সশস্ত্র বিপ্লবের পরও জনগণ জয়ী হয় নাই, বরং তারা হেরেছিল। তারা স্বাধীন দেশ পেলেও স্বাধীনতা পায় নাই। তাদের স্বাধীনতা লুট হয়েছিল স্বাধীন দেশ পাবার ২৬/২৭ দিনের মাথায়।
পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন একটি দেশ প্রতিষ্ঠা করলেও তারা স্বাধীনতা পায় নাই। পাকিস্তানি লুটেরা শাসকদের জায়গা দখল করেছিল বাংলাদেশের লুটেরা শাসকেরা। যা নিশ্চিত এবং জবাবদিহীহীন হয়েছিল ২৩ মার্চ ১৯৭২ সালে কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি অর্ডার (Constituent Assembly Order) জারির মাধ্যমে।
পাকিস্তানের ১৯৭০ সালের নির্বাচনটা ছিল গণপরিষদ নির্বাচন। এই গণপরিষদ নির্বাচনের নির্বাচিত প্রতিনিধি দিয়েই পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচিত হবার কথা ছিল। সেই শাসনতন্ত্র রচনার পরিবর্তে পাকিস্তানি শাসকরা জুলফি ভুট্টোর প্রোচনায় চাপিয়ে দিয়েছিল যুদ্ধ। রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলো। সংবিধান অবশ্য বাংলাদেশের জনগন পেয়েছিল ১৯৭২ সালে। ১৯৭২ সালের সেই সংবিধানই মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে নিল, যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, যে বিপ্লবের মাধ্যমে দেশটা স্বাধীন হলো সেই লড়াকু যোদ্ধাগোষ্ঠী (মুক্তিযোদ্ধা) এবং সেই যুদ্ধের নাম (মুক্তিযুদ্ধ) সংবিধান স্বীকৃতি দিল না, সংবিধানে স্থান দিল না, বরং আইনের নামে উপনিবেশিক আইন সহ পাকিস্তানি যেগুলি আইন প্রচলিত ছিল এবং ছিল না তাও বাহাল রাখল ১৯৭২ এর সংবিধান। সংবিধানের ১৪৯ ও ১৫২ অনুচ্ছেদ দেখলে তা পরিষ্কার হয়। অর্থাৎ রক্তক্ষয়ী একটি বিপ্লব (মুক্তিযুদ্ধ) করার পরও বাংলাদেশের জনগণ একটি স্বাধীন দেশ পেলেও একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারল না। যার ফলে বাংলাদেশের জনগণ এখনো নিষ্পেষিত নিপীড়িত অবহেলিত বঞ্চিত হচ্ছে প্রতি পদে পদে। এটা নিশ্চিত রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম করে বাঙালি বা বাংলাদেশের জনগণ জিতলেও পরাজিত হলো দিন শেষে।
রক্তক্ষই সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে এমন একটি সংবিধান বাংলাদেশের রচিত হলো যে সংবিধান জনগণের কোন অধিকারই সংরক্ষণ করে না এমনকি ভোটের অধিকারও দেয় না। যে বা যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে বিনা বাধাই তাকে পরেরবর্তী সময়ের জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার সুযোগ করে দেয় আমাদের এই সংবিধান। অর্থাৎ সশস্ত্র বিপ্লবও মানুষকে মুক্তি দেয় না স্বাধীনতা দেয় না।
০৭ জানুয়ারি ২০২৪ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো সংবিধানের দোহাই দিয়ে সংবিধানের কুট কৌশলে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করার সকল পথ উন্মুক্ত রাখল। দেশে সিংহভাগ জনগণ ভোটে উপস্থিত হলো না তারপরও ভোট হল, শপথ হল। এমপিগণের মেয়াদ শেষ হবার আগেই নতুন নির্বাচিত এমপিগণ শপথ নিলেন। সরকার গঠিত হবে এবং পাঁচ বছরের জন্য তারা দেশটা তালুক হিসেবে লিখে নেওয়ার সকল বন্দোবস্ত নিশ্চিত করল।
আমাদের এই সংবিধান চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে জনগণ কোন কিছুই না, সকল ক্ষমতার মালিক তারাই যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। নামে কেবল দেশটি হয়ে রইল গণপ্রজাতন্ত্রী [গণ(ক্ষমতা)তন্ত্রী] বাংলাদেশ। যেখানে জনগণের কোন ক্ষমতা নেই। নেই জনগনের নুন্যতম কোন অধিকার।
৭ জানুয়ারি ২০২৪ সালের নির্বাচন নিশ্চিত করেছে শাসকদের দমন পিড়ন নিশ্চিত করবার জন্যই আমাদের সংবিধান।
আমরা যতই বিপ্লবের কথা বলি না কেন দিনশেষে আমাদের দেশ পরিচালনার জন্য একটি নীতি নির্ধারণ করতেই হবে, অর্থাৎ দেশটা কিভাবে পরিচালিত হবে দেশ পরিচালনার নীতি কি হবে নির্ধারণ করতে হবে আর দেশ পরিচালনার এই নীতি নির্ধারণ করাটাই সংবিধান।
আমরা ১৯৭১ এ সশস্ত্র বিপ্লব করেছি। ১৯৯০ সালে আন্দোলন করেছি বারবার দেশের ঘাড়ে চেপে বসা স্বৈরশাসকের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে।
কিন্তু দেশ স্বৈরশাসক ফাসিস্ট মুক্ত হয় নাই। এর কারণ খুঁজে দেখতে গেলে দেখা যাবে আমাদের সংবিধান স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট মাফিয়াদের অভয় আশ্রম। বারবার তাদের হাতেই যেন আমাদের দেশটা পতিত হয় সে ব্যবস্থাই নিশ্চিত করে। সুতরাং একই খেলা বারবার না খেলে আমাদের সংবিধান সংস্কার করে জনমুখী জবাবদিহি মুলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সংবিধান সংস্কারের আন্দোলনে নামতেই হবে।
আপনার মতামত লিখুন :