তাহলে কি আমরা ধরে নেব ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবার তাদের ‘রিজার্ভ খেলোয়াড়’ নামাবে? যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারের গতকালের বক্তব্য শুনে তো তাই মনে হচ্ছে। বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের তিনি শান্তি সমাবেশ থেকে হুমকি দিয়েছেন। মাগুরার শালিখা থেকে যশোরের মণিহার হয়ে বিএনপির রোডমার্চ আজ মঙ্গলবার (২৬.০৯.২৩) খুলনায় পৌঁছানোর কথা। এর আগেই তিনি মুখ খুললেন।
শাহীন চাকলাদার যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য। অভিযোগ আছে, যশোরের অবৈধ ব্যবসা, জমির দখল, চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ সবকিছুই একসময় তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইদানীং এই আধিপত্যে নাকি খানিকটা ভাটা পড়েছিল। তাই তিনি নিজের নির্বাচনী এলাকা কেশবপুরে হুংকার দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। মাঝেমধ্যে ঝিকরগাছাতেও সভা-সমাবেশ করছিলেন। নির্বাচনের আগে যশোরে ফিরেছেন চেনা চেহারায়।
প্রথম আলোর খবরে এসেছে, শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘তারেকের (তারেক রহমান) কথা শুনে যশোরে বিশৃঙ্খলা করলে বিপদে পড়বেন। মামলা খাবেন। মামলায় যদি না থামেন, তাহলে কিন্তু আমাদের কাছে মার খাবেন।’
তিনি বলেন, ‘যারা বিএনপির নেতাদের কথা শুনে ঢাকার সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন, পদযাত্রা, রোডমার্চে অংশ নেবেন, তাদের আর যশোরে ফিরতে দেওয়া হবে না। আপনাদের বাড়ির পাশে কিন্তু অনেক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীর বসবাস। তারা কিন্তু আপনাদের বাড়িঘর সব চেনেন। ফলে পরবর্তী সময়ে কী ঘটবে, সেটা আর এখানে বললাম না! রোডমার্চে যশোরে যদি আগুন-সন্ত্রাস করেন; তাহলে কিন্তু খেলা হবে।’
যশোরের আট উপজেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদককেও তিনি নাকি নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে খোঁজখবর রাখতে। শুধু মামলা আর মারধর, বাড়িঘরে হামলার হুমকি দিয়েই তিনি থামেননি, প্রচ্ছন্নে হত্যার হুমকিও দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ‘২০৪১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে। ফলে লন্ডনে থাকা তারেকের কথা শুনে যশোরে বিশৃঙ্খলা করলে কিন্তু আপনারা বিপদে পড়বেন। আপনাদের নেতা কিন্তু বাঁচাবে না।’
শাহীন চাকলাদার কী কী শব্দ ব্যবহার করেছেন একটু খেয়াল করুন, ‘যশোরে ফিরতে দেওয়া হবে না’, ‘মামলা খাবেন’, ‘আমাদের কাছে মার খাবেন’, ‘আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আপনাদের বাড়িঘর সব চেনেন’, ‘খেলা হবে’ ও ‘আপনাদের নেতা কিন্তু বাঁচাবে না।’ মানে হলো, তিনি ধরবেন, মারবেন, বাড়িছাড়া করবেন এবং এমন কাণ্ড ঘটাবেন যে বিএনপির নেতারা এসেও কর্মীদের প্রাণরক্ষা করতে পারবেন না। প্রয়োজনে আদালতকেও ব্যবহার করবেন।
আর এত কথা তিনি বলেছেন, কোতোয়ালি থানার সামনে দাঁড়িয়ে মাইক মুখে নিয়ে। মানে পুলিশ যদি শুনতে না-ও চায়, উপায় নেই। তার বক্তব্য পুলিশের কানে গেছেই। এত কথার পর পুলিশ কী করেছে জানতে কথা হয় যশোরের স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে। তারা বলেন, শাহীন চাকলাদারেরা যেন সভা-সমাবেশ ঠিকঠাক মতো করতে পারেন, সে জন্য শহরের যান চলাচলের রুট বদলে দিয়েছিলেন। সভার চারপাশেও পুলিশ ছিল। এখনো এই হুমকি নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা যায়নি। অথচ তিনি যেসব হুমকি দিয়েছেন, তার সবই ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য।
শাহীন চাকলাদার কী করতে পারেন বা কী করেন—তার দু-চারটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বছর কয়েক আগে তার সঙ্গে থানার এক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কথোপকথন ফাঁস হয়। যদিও শাহীন চাকলাদার দাবি করেন, ওই বক্তব্য ‘টেম্পারিং’ করা হয়েছে।
ওই ফোনালাপে তিনি পরিবেশকর্মী শেখ সাইফুল্লাহকে শায়েস্তা করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন, ‘আপনি এখন রাত্তিরে থানায় বোম মারেন একটা। মারায়ে ওর নামে মামলা করতে হইবে। পারবেন? আপনি থাকলে এগুলো করতে অইবে। না অইলে কোন জায়গায় করবেন? আমি যা বলছি, লাস্ট কথা ইডাই। যদি পারেন ওই এলাকা ঠান্ডা রাখতি, আমি বন ও পরিবেশ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য। ওখানে কারও বাপের ক্ষমতা নেই। সে (সাইফুল্লাহ) বারবার যে এরকম করে, আপনি কী করেন?’ এর উত্তরে ওসি বলেন, ‘ও তো স্যার হাইকোর্টের কাগজ নিয়া আসে বারবার।’ এরপর শাহিন চাকলাদার বলেন, ‘আরে কোথার হাইকোর্ট-ফাইকোর্ট। কোর্ট-ফোর্ট যা-ই বলুক, বলুইগ্যা। আমাদের খেলা নাই? খেলা নাই?’
গায়েবি মামলার শিকার হয়েছেন যারা, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলার এজাহারে এ ধরনের অভিযোগের উল্লেখ আছে। আমরা কী ধরে নেব, সারা দেশে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে হামলা, ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার যত মামলা হয়েছে, সবই এই ধাঁচের? প্রতিটির পেছনেই এমন একজন শাহীন চাকলাদার আছেন। অবশ্য শাহীন চাকলাদারেরা যে সর্বেসর্বা ও আইনের ঊর্ধ্বে, তার প্রমাণ তাঁরা বারবারই রেখেছেন।
গত বছর জেলা প্রশাসনের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠানে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ ইখতিয়ারুল ইসলাম মল্লিকের দিকে তেড়ে গিয়েছিলেন তিনি। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাঈমুল ইসলাম হত্যা মামলার আসামিকে কেন জামিন দেননি, বিচারকের কাছে সেই কৈফিয়ত দাবি করেছিলেন তিনি।
ওই অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, সংসদ সদস্য, পৌরসভার মেয়র, পুলিশ সুপার, যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক, যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, সরকারি এম এম কলেজের অধ্যক্ষ, সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ছিলেন, তবে এ জন্য তার কিছুই হয়নি।
দেখার বিষয় নির্বাচনের আগে একজন সংসদ সদস্যের এসব হুমকির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো কী করে। নির্বাচনের আগে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে এই হুমকি একধরনের বাধা বলে কি বিবেচনা করবে জাতীয় নির্বাচন কমিশন? মারধর, হামলা, প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ায় কি পুলিশ প্রশাসন কিছু বলবে? দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কি কোনোই দায় নেই? নাকি দলের হাইকমান্ডের নির্দেশেই শাহীন চাকলাদার এমন বক্তব্য দিয়েছেন?
আমরা নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমানকে ‘খেলা হবে’ বলে হুমকি দিতে শুনেছি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ঢাকায় ঢুকতে দেবেন না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আর গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথাটাও ভুলে যাবেন না যেন। শাহীন চাকলাদার যখন যশোরের শান্তি সমাবেশে হুমকি দিচ্ছেন, ওবায়দুল কাদের তখন ঢাকার শান্তি সমাবেশে। তিনি বিএনপিকে ৩৬ দিনের আলটিমেটাম দিয়ে বলেছেন, এই সময়ের মধ্যে বিএনপি যদি ‘সংশোধন’ না হয়, তাহলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের অপরাজনীতির কালো হাত ভেঙে দেওয়া হবে।কী বুঝলেন?
আপনার মতামত লিখুন :