টোল ফ্রি নম্বর


নিউজ ডেক্স প্রকাশের সময় : নভেম্বর ৪, ২০২২, ৬:৫২ অপরাহ্ন
টোল ফ্রি নম্বর

হ্যালো, আচ্ছা আপনাদের থেকে একটা ফ্রিজ নিয়েছিলাম, কাজ করছে না, একটু বাড়ি এসে দেখে যাবেন?

হ্যাঁ নিশ্চয়ই, ঠিকানা টা বলুন। আমাদের এক্সিকিউটিভ কাল চলে যাবে।

কলিং বেল এর শব্দে মোহনবাবু দরজাটা খুললেন।
এই বাড়িতে বৃদ্ধ বৃদ্ধার বাস। ছেলে কাজের সূত্রে বাইরে থাকে। বছরে একবার আসে।

এই যে বাবা এখানে, ফ্রিজটা দিয়ে জল পড়ে আর দেখো এটা বন্ধ হয় না ঠিকমতো।

হ্যাঁ দেখে নিচ্ছি। কতদিন হয়েছে ফ্রিজ টা কিনেছেন?

খুব বেশিদিন হয় নি বাবা। যখন কিনেছিলাম বলেছিল ৩ বছর গ্যারান্টি আছে। ৩ বছর হয়নি এখনও ।

কয়েকটা পার্টস পালটাতে হবে। তিন বছর হয়ে গেছে কি? তাহলে শুধু সার্ভিস চার্জ টা দিতে হবে। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে এটা তিন বছরের বেশি। আপনি বিল টা দিন, আমি দেখে বলছি৷

বিলটা তো নেই, হারিয়ে গেছে পাশ থেকে বলে উঠলেন মোহনবাবু।

ফ্রিজ রিপেয়ারিং করতে আসা ছেলেটার নাম অসিত। তাকে দেখে নিজের ছেলের কথা ভাবতে বসলেন আলো দেবি।

আমার ছেলেও তোমারই বয়সী। কবে থেকে বলছি আসতে, সময় ই নেই।

অন্যদিকে অসিতেরও মনে পড়ে যায় ওর মা – বাবার কথা। সেই যে কবে দেশের বাড়ি থেকে কাজের জন্য কলকাতায় চলে আসলো, তারপর কতদিন ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারে নি গ্রামে। উপার্জনের সবটুকুই প্রায় পাঠিয়ে দেয় বাড়ি।

ম্যাডাম ঠিক হয়ে গেছে। বিলটা একটু খুঁজে দেখুন…

এই নাও বাবা, বিলটা পেয়েছি।

নাহ, তিনবছর হয়নি। শুধু সার্ভিস চার্জটুকু দিলেই হবে।

মোহন বাবু আর আলো দেবির কাচুমাচু মুখ দেখে অসিত বুঝতে পারে ওদের কাছে টাকাটা নেই।

চোখের কোন থেকে টপ টপ করে জল বেরোয় মোহনবাবুর। নিজের সর্বস্ব দিয়ে ছেলেটাকে মানুষ করলাম। এখন আর আমাদেরকেই দেখে না। আগে টাকার দরকার হলে বলতাম। এখন আর বলি না। বার বার চাইতে খুব খারাপ লাগে। আমায় কটা দিন সময় দাও আমি তোমাদের দোকানে গিয়ে দিয়ে আসবো।

ম্যাডাম টাকাটা লাগবে না। আসলে আপনি অনেক পুরনো কাস্টমার। তাই আমরা এটা ফ্রিতে রিপেয়ার করলাম।

আসলে মোহনবাবু আর আলো দেবিকে দেখে অসিতের নিজের বাবা মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছিল।

আলো দেবী রান্না ঘরে গিয়ে একটা টিফিন কৌটো নিয়ে আসে। এটা তোমার জন্য। আমি গাছের নারকেলের নাড়ু বানিয়েছিলাম, আমার ছেলে প্রতি বার নিয়ে যায়। আর বলে কেন যে এসব বানাও। এখন সবই কিনতে পাওয়া যায়, ইচ্ছে হলে কিনেই তো খেতে পারি। একটুও বোঝেনা যে মায়ের মন, ছেলের জন্য কিছু করে দিলে কত আনন্দ হয়। এদিকে আসলে মাঝে মাঝে এসো….

তার পর থেকে মাঝে মাঝে অসিত আসতো ওদের বাড়ি। জেঠু জেঠিমা বলে ডাকতো ওদের। সাধ্য মতো খেয়াল রাখতো। আলো দেবীও রান্না করে খাওয়াতো অসিতকে।

তারপর হঠাৎ একদিন এসে দেখলো জেঠু আর নেই। জেঠিমাকে ছেলে বিদেশে নিয়ে যাবে, তাই বাড়ি বিক্রি করে দেবে। কিন্তু আলো দেবি বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হল না। তাই অগত্যা মাকে রেখেই ছেলে ফিরে গেল নিজের দেশে৷

অসিত জেঠিমার দায়িত্ব নিল। বাজার করে দেওয়া, কাজ থেকে ফিরে খোজ নেওয়া। তারপর একদিন বাড়ি টা অসিতের নামে লিখে দিলেন আলো দেবী।

তারপর থেকেই সবকিছু কেমন যেন পালটে গেল…

জীবনের শেষ সময়ে এসে বুঝলাম, জীবনে ভালো শিক্ষার থেকে দামী কিছু নেই। ভালো মানুষ হওয়াটাই আসল, যেটা সবাই পারেনা৷

বৃদ্ধাশ্রমে এভাবেই নিজের জীবনের গল্প শোনাতে শোনাতে গলা ভারি হয়ে গেল আলো দেবীর।

পূজা পালচৌধুরী
কবি, সাহিত্যিক, লেখক
আরোমা পার্ক, কলকাতা।

ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন: