স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাংকনোট ও ধাতব মূদ্রার নকশাকার কে জি মুসতাফার মৃত্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের শোকবার্তা


নিউজ ডেক্স প্রকাশের সময় : জুলাই ১১, ২০২৩, ৮:৪৮ অপরাহ্ন
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাংকনোট ও ধাতব মূদ্রার নকশাকার কে জি মুসতাফার মৃত্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের শোকবার্তা

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম টাকা ও কয়েনের নকশাকার শিল্পী কে জি মুস্‌তাফা গত শুক্রবার ৭ই জুলাই ভোর ৩টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর হলি ফ‍্যামিলি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত‍্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের সমস‍্যাসহ বার্ধক‍্যজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন কে জি মুস্‌তাফা। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ বহু আত্মীয়স্বজন এবং শুভাকাঙ্খী রেখে গেছেন।

চিত্রশিল্পী কে জি মুসতাফার মৃত্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার শোকবার্তা দিয়েছেন।

কে জি মুসতাফা ১৯৪৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর শেখপুর গ্রামে এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ভর্তি হন তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটসে (বর্তমানে চারুকলা ইনস্টিটিউট) এবং ১৯৬৪ সেখান থেকে লেখাপড়া শেষ করেন। চারুকলার শিক্ষক শ্রদ্বেয় শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন তরুণ মুসতাফার ভিতরে অসাধারণ প্রতিভার খোঁজ পান।

আর্ট কলেজের চৌহদ্দি পেরোতে না পেরোতেই ১৯৬৪ সালে কে জি মুস্​তাফা চলে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। যোগ দিলেন পাকিস্তান সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনে, নিষ্ঠার সাথে শুরু করলেন পাকিস্তানের ডাকটিকিট ও মুদ্রার কাজ। মুসতাফা সেখানে কাজের মন বসাতে পারলেন না, ১৯৬৭ সালে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে জ্যৈষ্ঠ ডিজাইনার হিসাবে ঢাকা এসে এশিয়াটিক অ্যাডভারটাইজিং লিমিটেড কোম্পানীতে যোগদান করে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।

যখন সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন মূদ্রা ও টাকার প্রয়োজন হয়ে পরে সেই সময় বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনকে নিয়ে দেশীয় মুদ্রা ডিজাইন করার জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের টিম গঠন করা হয়। শিল্পাচার্য তার প্রিয় ছাএ মুসতাফাকে এই বিশাল দায়িত্বের যোগ্য মনে করে তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর এ এন হামিদুল্লাহ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন এবং গভর্নরও মুসতাফাকে পেয়ে যেন চাঁদ হাতে পেলেন।

কে জি মুস্তফা নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুদ্রা ১ টাকার নোটের দুটি নকশা করেন। এভাবে ৫, ১০ টাকার দুটি এবং ১০০ টাকার ১টি নোটের ডিজাইন করে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং হামিদউল্লাহ সাহেবের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিলেন। কাগজের টাকার পর ১, ৫, ১০, ২৫ এবং ৫০ পয়সার ধাতব মুদ্রার নকশা করেন।

একই বছরে, অর্থাৎ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ডাকবিভাগের অসংখ্য ডাকটিকিট, পোস্টকার্ড, খাম, অ্যারোগ্রামের পর নন-জুডিশিয়াল, কোর্ট ফি, রাজস্ব ডাকটিকেট, রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারী ব্যাংক এবং প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা দলিলের অসংখ্য নকশার ডিজাইন করেন।

পরবর্তী সময়ে সিপাহি বিদ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে, বাংলাদেশের প্রথম আদমশুমারি, গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ, পাটের শিকা ও কার্পেট, গ্রামীণ নারী কলম্বো পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরতা বর্ষ, অলিম্পিক গেমস, ফিফা বিশ্বকাপ, এশিয়ান গেমস প্রভৃতি বিষয়ের ওপর ডাকটিকিটে তিনি ডিজাইন করেছেন।

মহান স্বাধীনতার প্রথম বার্ষিকী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী, কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের স্মরণে, বিশ্ব ডাক সংস্থার শতবর্ষ উদযাপন, ডাক জীবন বীমা শতবার্ষিকী, ডাকটিকিট প্রকাশের ১৫০তম বার্ষিকী সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে তিনি ডাকটিকেটের নকশা করেছেন।

সেই সাথে তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলা, লালন শাহ ও কবি কায়কোবাদের ওপর অনেক ডাকটিকিটের ডিজাইন করে দিয়েছেন। শহীদ নূর হোসেনের বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ লেখা যে ডাকটিকিটটি বেরিয়েছিল, সেটির ডিজাইন করে তৎকালীন সময়ে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এই গুণী শিল্পী। ১৯৯১ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরিজ ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়, সেগুলোর মধ্যে দশটির ডিজাইন করেছেন তিনি। তিনি অসংখ্য ব্যাংক, বীমা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রাম, চেক বই, ভাউচার, প্রাইজবন্ড, শেয়ার সার্টিফিকেট, সঞ্চয়পত্রের সার্টিফিকেটসহ অনেক কাজের ডিজাইন করেছেন। পাশাপাশি তিনি অনেক ছবিও এঁকেছেন।

জীবিত অবস্থায় তিনি কোন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো বড় ধরনের পুরস্কার বা স্বীকৃতি পাননি। মৃত্যুর আগে সব সময় তিনি বলে গেছেন, ‘এই দেশই আমার জন্য পুরস্কার।’

ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন: