বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত এসব বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে আগামীতে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে দাবি দাওয়া তুলে ধরেছেন।
সব দলই জানিয়েছেন তারা ১৫ বছরের জঞ্জাল সংস্কার করেই নির্বাচন চাচ্ছেন। পতিত হাসিনার সময়ের অনিয়ম-দুর্নীতির বিচার, আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রশাসনের দলবাজ আমলা ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাদ দেয়া, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, প্রশাসনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কারসহ বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছেন।
তারা বলেছেন, দীর্ঘদিন থেকে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারছে না। হাসিনা রেজিম পুলিশ ও আমলাদের ব্যবহার করে নির্বাচনের নামে পাতানো খেলা খেলেছেন। হাসিনার রেখে যাওয়া সব জঞ্জাল পরিষ্কার করেই নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। নির্বাচনের ব্যাপারে তাড়াহুড়ার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন সরকারকে কঠোর ভাবে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এবং আইন শৃংখলা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা।
এ ছাড়াও প্রশাসনে কর্মরত আওয়ামী লীগ অনুগত আমলা, পুলিশ কর্মকর্তাদের রেখে সংস্কার সম্ভব নয় বলেও মত দিয়েছেন। বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য নিশ্চিত করা, দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া, নির্বাচনী ব্যবস্থাসহ সাংবিধানিক বেশ কিছু সংস্কারের দাবিও উপস্থাপন করেছি। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী একাধিক নেতা জানান, আমরা প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত সময়ে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির জন্য প্রধান উপদেষ্টার কাছে দাবি জানিয়েছি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকার অযৌক্তিক সময় নষ্ট করবে না বলে জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময়ে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) থেকে ৮৩ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে ১৩ দফা দাবিনামা তুলে ধরা হয়েছে। হেফাজত ও ইসলামী ধারার ৬টি দল (মোট ৭টি) দল থেকে ৬টি প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও গণফোরাম, বাংলাদেশের জাসদ, জাতীয়তাবাদী সমমনা দল, জাতীয় পার্টি, ১২ দলীয় জোট থেকে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গতকাল শনিবার বিকেল ৩টায় হেফাজত এবং ৬টি ইসলামী দল বৈঠক করেন। অতঃপর বিকেল ৪টায় লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বিকেল ৫টায় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, সন্ধ্যা ৬টায় বাংলাদেশ জাসদ ও ১২ দলীয় জোট, সন্ধ্যা ৭টায় গণফোরাম ও জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি দল বৈঠকে মিলিত হন।
বৈঠক শেষে বেরিয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতা ও বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তি দুইবারের বেশি সময় যাতে না থাকেন, সেই প্রস্তাব তারা দিয়েছেন। এ ছাড়া একটা যৌক্তিক সময় নিয়ে সংস্কারগুলো করে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে বলেছেন। নির্বাচনে অযথা কালবিলম্ব যেন না করা হয় সেটা উল্লেখ করেছেন। মামুনুল হক বলেন, ইসলামী দলগুলোর এমন প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একমত পোষণ করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর কালবিলম্ব না করে নির্বাচনের দিকে চলে যেতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন।
যৌক্তিক সময়টা কত দিনের সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মামুনুল হক বলেন, যৌক্তিক সময়ের বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাবনা দেওয়া হয়নি। সুনির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ নিয়ে আমরা আলোচনা করিনি।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রত্যেকটা দল সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরেছে জানিয়ে মামুনুল হক বলেন, নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার, নির্বাচনবিধি সংক্রান্ত সংস্কার; সাংবিধানিক সংস্কার, দুই মেয়াদের বেশি একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা বন্ধ করা, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দলীয় পদ থেকে পদত্যাগের বিধান করা; সংসদ সদস্যদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেওয়ার সুযোগ রাখা; বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করা বিচার বিভাগে সরকারের হস্তক্ষেপমুক্ত রাখার স্বার্থে বিচারপতি নিয়োগ ও বিয়োগের জন্য জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা; শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিতর্কিত বিষয়গুলো বাদ দিয়ে ধর্মীয় ও নৈতিকতা শিক্ষা সংযোজন করা; পুলিশ ও প্রশাসনকে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের ব্যবহারের পথ বন্ধ করা; কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী আইন ও নীতি প্রণয়ন না করা তথা ৬টি দাবি তুলে ধরেন।
বৈঠকে হেফাজতে ইসলাম সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফতে মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, নেজামে ইসলাম ও খেলাফত আন্দোলনের নেতারা যোগ দেন।
বৈঠকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সম্মানিত উপদেষ্টামণ্ডলী বরাবর ১৩ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। দাবিগুলো হচ্ছে, বিদ্যমান সংবিধান নিয়ে নানাবিধ বিতর্ক আছে। তাছাড়া বিগত দিনের ক্ষমতাসীনরা দলীয় স্বার্থে সংবিধানে নানারকম পরিবর্তন করেছে। এ জন্যে বর্তমান সংবিধানকে বাতিল করে একটি সাংবিধানিক কমিশন গঠন করে নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরি করা এবং গণভোটের মাধ্যমে তা অনুমোদন করা; গ্রহণযোগ্য তদন্ত কমিশন ও স্বতন্ত্র ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জুলাই গণহত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। একইসঙ্গে গত ১৬ বছরে সংঘটিত সকল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হত্যাকাণ্ড, গণহত্যা, গুম ও মানবাধিকার লংঘনের বিচার; তদন্ত সাপেক্ষে বিগত বছরের সকল দুর্নীতিবাজ ও বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের সকল সম্পত্তি ক্রোক করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতে হবে এবং বিদেশে পাচারকৃত টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে; আইনশৃংখলা বাহিনী, প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ প্রজাতন্ত্রের যে সকল কর্মচারী আইন, সংবিধান, শপথ লংঘন করে অপেশাদার আচরণ করেছেন তাদের বিচার; পতিত ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনকে ব্যবহার করে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের ৩টি অবৈধ ও প্রহসনের নির্বাচন পরিচালনাকারী কমিশন এবং প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা তাদের অবৈধ কাজের কুশীলব ছিল, তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির মুখোমুখি করা; বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল; নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইনশৃংখলা বাহিনীসহ সরকার তাদের সংস্কার কার্যক্রমের ধরণ ও প্রক্রিয়া এবং কতদিনের মধ্যে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করবে, তা অতিদ্রুত প্রকাশ করবে এবং জাতীয় নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা; আওয়ামী দুঃশাসনে বিগত ১৬ বছরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাখাতের ক্ষতি দ্রুত সময়ের মধ্যে কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে দেশপ্রেমিক শিক্ষাবিদ ও উলামায়ে কেরামের সমন্বয়ে একটি জাতীয় শিক্ষাকমিশন গঠন; ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর ঢালাওভাবে রাতারাতি যে সব নিয়োগ, বদলি ও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এসব বিশ্লেষণের জন্য একটি কমিশন গঠন; ঢালাওভাবে হয়রানিমূলক এবং মিথ্যা মামলা করা যাবে না; দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনা ও অনুভূতির বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকারও রক্ষা; নতুন করে চাঁদাবাজি, দখলদারি ও হয়রানি কঠোর হস্তে দমন; নব্য চাঁদাবাজ, দখলবাজ, অবৈধ অস্ত্রধারী ও সন্ত্রাসীদের দমন করতে সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর দ্রুত যৌথ অভিযান।
আপনার মতামত লিখুন :