বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা কি গণতান্ত্রিক?


নিউজ ডেক্স প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ২৫, ২০২৩, ১২:৪৭ অপরাহ্ন
বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা কি গণতান্ত্রিক?

বাংলাদেশে বারবার স্বৈরশাসন ফিরে আসে কেন? কেনই আমাদের সেই একই খেলে ৫২ বছর ধরে খেলতে হচ্ছে? “স্বৈরাচার হটাও”সরকার বদল কর। এই একই খেলার মধ্যে জনগণকে আটকে রাখা যাচ্ছে কি করে? এই একই খেলা যদি বারবার বাংলাদেশের মানুষকে খেলতেই থাকতে হয় তবে বাংলাদেশ সোনার বাংলাদেশ না হয়ে শ্মশানে পরিণত হবে হতেই থাকবে সেটি বুঝতে কি আইএ বিয়ে পাশ করতে হয়? বাংলাদেশে তলা বিহীন ঝুড়ি সেটি বাংলাদেশ ব্যাংক এর কর্মকর্তার বরাতেই নিশ্চিত হয় যখন তিনি বলেন বাংলাদেশের ঋণের বোঝা বাংলাদেশের মানুষকে টানতে হবে ৬২ (বাষট্টি) বছর। বাষট্টি বছর দেশটাকে এই অবস্থায় স্থির রেখে কেবল ঋণের বোঝাই টানবেন? বাষট্টি বছর ঠিক এইই অবস্থায় দেশটা কি থেকে যাবে নাকি ততদিনে দেশটা শ্মশানে পরিণত হবে?

কেন এমন হচ্ছে?

এরশাদই এ দেশে প্রথম স্বৈরাচার ছিলেন না। বলা বাহুল্য শেষ স্বৈরাচারও তিনি নন। আগেও বিভিন্ন সময় আমরা এই দেশে – এই ভূখণ্ডে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছি। ইতিহাস সাক্ষী। পাকিস্তান আমলে ইয়াহিয়াকে বলা হতো সবচেয়ে বড় স্বৈরাচার। তার পতনও মূলত এ ভূখণ্ডের লোকেরা আন্দোলন সংগ্রাম করে, জীবন দিয়ে নিশ্চিত করেছে। এর পরম্পরায় পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় এবং আমরা অকাতরে জীবন দিয়ে জয়ী হয়ে লাভ করি স্বাধীন দেশ। ইয়াহিয়া স্বৈরাচার হবার পেছনে কাজ করেছিল তার একক সিদ্ধান্তে দেশ পরিচালনার নীতি, কারন সে সময়ে পাকিস্তান নামক দেশটি পরিচালনা করবার জন্য দেশ পরিচালনার নীতি (সংবিধান) ছিল না।

দেশ পরিচালনা নীতি / সংবিধান থাকার পরও বারবার স্বৈরচার ও স্বৈরশাসন ফিরে আসে কেন?

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে একটি স্বাধীন দেশ পাবার সাথে সাথে দেশ পরিচালনার নীতি / সংবিধান রচিত হল। যেই সংবিধান পাকিস্তানী স্বৈরশাসন কে লিখিত রূপে বলা ভাল প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করল। গণ-প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে গচ্ছিত রেখেই কেবল ক্ষান্ত হল না বরং সেই ব্যক্তিকে সংবিধানের উপর স্থান দিল। যার ফলে দেশের নাম ’গনপ্রজাতন্ত্রিক বাংলাদেশ’ হলেও দেশটি আক্ষরিক রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যবস্থা থেকে গেল স্বৈরচার দারা শাসিত একটি স্বৈরাচারী রাষ্ট্র।

স্বৈরাচার ও স্বৈরশাসনের উৎস

বাংলাদেশে যে স্বৈরশাসন এসেছে, আসছে সেটি আসছে সেই রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা / সংবিধানের হাত ধরেই। ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে স্বৈরশাসন চলেছে; বাংলাদেশে সেই স্বৈরশাসকদের এই সংবিধান বিচারের সম্মুখীন করতে পারে নাই, বরং বৈধতায় দিয়েছে। যখন কোন অপরাধ বিচারের ঊর্ধ্বে থাকে অথবা বিচারের আওতায় আসে না তখন সেটি অপরাধ হিসাবে গণ্য হবার কোন যৌক্তিক কারন নাই। অনেকেই হয়তো বলবেন, স্বৈরশাসক এরশাদের বিচার হয়েছে, হা হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদের বিচার হয়েছে সত্য তবে সে বিচার হয়েছে অন্য কারনে, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের কারনে স্বৈরশাসক হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদের বিচার হয় নাই। যেহেতু সংবিধানে অবৈধ ভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে অপরাধকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করে না, সে কারনে বারবার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ক্ষমতায় বসা বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থায় অপরাধ নয়।

প্রথম অবৈধ ভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের ঘটনা

উল্লেখ্য রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের এই খেলা বাংলাদেশে প্রথম ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ এর পর ঘটছে এবং ঘটে চলেছে বিষয়টা এমনও নয়। সবার প্রথমে বাংলাদেশে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের ঘটনা ঘটে সংবিধান রচনা এবং সংবিধান গ্রহণের সময় জনগণকে বাহিরে রাখবার ভেতর দিয়ে। জনগণ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিই সংবিধান। একটি রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে টা নির্ধারণ করবে সে দেশের জনগণ।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালিত হবে কি ভাবে সে পদ্ধতি ঠিক করে রাষ্ট্রের শাসকেরা (সংসদ!) একক ভাবে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার কারা গঠন করবে সে মতামতের তোয়াক্কাও করা হয় নাই। স্বাধীন বাংলাদেশে কোন জনপ্রতিনিধি নির্বাচন ছাড়াই রচিত হল স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান / রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা। যারা স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় পরিচালিত পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন তারাই রচনা করলেন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের সংবিধান। পাকিস্তানী শাসকের জায়গা দখলে নিলো বাংলাদেশের শাসক। পাকিস্তানী শাসন শোষণ বহাল থেকে গেল।

দ্বিতীয় দফায় স্বৈরাচার ও স্বৈরশাসকের আবির্ভাবের পথ

গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের শাসক নির্ধারিত হয় নির্বাচনকে বিসর্জন দিয়ে সরাসরি স্বৈরাচারী কায়দায় জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে, সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। সংবিধান বা রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি যেহেতু এই অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে না এবং ক্ষমতাসীন প্রধানকে ইম্পিচমেন্ট করবার ক্ষমতা সংসদকে দেয় না সেহেতু দেশের নাগরিক এর সমাধান খোঁজে ভায়োলেন্ট হয়ে। ফলাফল শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড, যা কোন গণতান্ত্রিক দেশে কাম্য হতে পারে না।

একটি দেশের শাসন পদ্ধতি বুঝবার উপায়

একটি দেশ ধর্মীয় শাসন দারা পরিচালিত, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক নাকি এক ব্যক্তির শাসনের দেশ সেটি নির্ধারণ করে দেশটি কি ভাবে পরিচালিত হবে যে পদ্ধতি তার উপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা যেহেতু ক্ষমতা কাঠামকে একব্যক্তি কেন্দ্রিক স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা কাঠামো নির্মাণে প্রশ্নাতীত স্বাধীনতা দেয় সে কারনে বাংলাদেশে স্বৈরাচারী শাসন ছাড়া ভিন্ন কিছু প্রত্যাশা করবার কোন জায়গা আসলে নাই, যদিও দেশটির নাম গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ।

যেহেতু একটি দেশ গণতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক সেটি নির্ধারণ করে সংবিধান সেহেতু দেশটিকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে বিবেচনা করতে গেলে প্রথমেই সংবিধানের প্রতি নজর দেয়া উচিৎ, দেখে নেয়া উচিৎ দেশটি গণতান্ত্রিক হবার ব্যবস্থা সংবিধান নিশ্চিত করে বা না। সংবিধান কে স্বৈরতান্ত্রিক রেখে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পাওয়া যাবে না।

গণতান্ত্রিক দেশ পাবার পথ ও উপায়

কেউ কেউ নতুন সংবিধান রচনার কথা বলছেন। আবার কেউ কেউ বিপ্লবের আহ্বান করছেন। যে যাইই করুন না কেন দিন শেষে একটি সুস্থ রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা নিশ্চিত করবার জন্যই তা করছেন। অর্থাৎ সবার লক্ষ্যই জনগণের সুখ শান্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। ১৯৭০ সালে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে যা যা করা দরকার তার কিছু ধাপ আমরা পেরিয়ে এসেছি ইতোমধ্যে। এখন প্রয়োজন একটি সুস্থ রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা, যা সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে অনেক সহজেই করা সম্ভব।

মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের গণপ্রজাতন্ত্রিক বাংলাদেশ পেতে আমাদের রাষ্ট্র সংস্কার লাগবেই লাগবে। রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে বেশ সহজেই আমরা তা পেতে পারি। সে কারনে অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের অধীনে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করে জনমুখি একটি সংবিধান আমাদের লাগবেই লাগবে।

আদীল হোসেন।
কলামিস্ট।

ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন: