বাংলা ভাষা আমাদের প্রাণের অহঙ্কার, ও গর্বের ভাষা। ১৯৫২ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছিলাম বাংলা ভাষার সাংবিধানিক মর্যাদা, সেজন্যই মূলত বাঙ্গালীর মাতৃভাষাগত প্রাণ। ভাষার জন্য রক্ত দেয়া জাতি আর আছে কিনা জানা নেই। সেই মূল্যবান আপনার ভাষা প্রবাসে সন্তানের ভেতর প্রতিফলন ঘটানো এখনই জরুরী।
প্রবাসে সন্তানেরা বাংলা ভাষা শিখতে পারলে তারও একটা সুফল পাওয়া যাবে। আসলে আমাদের বাঙালিত্ব কিংবা নৃতাত্ত্বিক পরিচয় তো আমরা মুছে ফেলতে পারব না। সৈয়দ শামসুল হক বলতেন, জাতীয়তা তো একটা জামা নয় যে একটা খুলে আরেকটা পরে নিলেই হয়ে যায়। আমরা পাসপোর্ট বদলাতে পারব, নাম বদলাতে পারব; বাঙালিত্বের যে জিন নিয়ে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি, সেটা তো আর চাইলেও বদলাবে না, সেই বাঙালীয়ানা যেন প্রবাসের সন্তানেরা ধারণ করতে পারে।
বড় যে বিষয়টি প্রবাসীদের ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা চর্চার পেছনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তাহলো পরিবেশ। অনেক বাচ্চারা কথা বলতে শুরু করে সুন্দর বাংলা দিয়ে, কিন্তু একটু বড় হলেই আর ওরা বাংলা বলতে চায়না এবং এতে অনভ্যস্থ হয়ে পড়ে। এ সমস্যাটা সবচেয়ে বেশী প্রকট হয়ে পড়ে যখন তারা স্কুলে যেতে শুরু করে। স্কুলের ভাষা, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইংরেজী, বলেই বাচ্চারা সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাদের বন্ধু এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে ঐ ভাষায় কথা বলতে তারা এত বেশী অভ্যস্থ হয়ে পড়ে যে তারা আর কোনভাবেই বাংলা বলতে পারেনা। বরং বাংলা বলতে জোর করার মানে হয় তাদেরকে আযাবে নিক্ষেপ করার মত। স্কুল ছাড়াও তারা প্রতিদিন মিডিয়ার, বিশেষ করে টেলিভিশনের মুখোমুখি থাকছে ঘন্টার পর ঘন্টা, যার ভাষা বাংলা নয়। সেখানেও তারা বাংলা বিমুখ হয়ে গড়ে উঠে।
কিছু অভিভাবক আছেন যারা বাংলা শেখা বা বলার জন্য সন্তানদের কোন পরিবেশই দেননা। তাঁরা তাদের সন্তানদের মাতৃভাষাই বানিয়ে দেন ইংরেজী। কারন তাদের বাচ্চারা কথা বলতে শুরু করলেই তাঁরা তাদের সাথে ইংরেজীতে কথা বলা পসন্দ করেন, যদিও বাচ্চারা বড় হয়ে তাদের বাবা-মায়ের ইংরেজী উচ্চারণ নিয়ে হাসাহাসি করতেও দ্বিধা করেনা। এশ্রেণীর অভিভাবকরা বুঝেননা যে এখানকার বাচ্চারা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ইংরেজী শিখবে। ইংরেজী তাদেরকে বলে শেখাতে হবেনা; বরং তাদের যা বলে শিখিয়ে অভ্যেস করাতে হবে তা হলো মাতৃভাষা।
এই প্রবাসেও হয়ত আমরা অনেক পিতা-মাতাই তাদের সন্তানদের সাথে শুধুমাত্র নিজেদের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে ফেলি। ফলে ঐ সব ছেলেমেয়েরা শুদ্ধ বাংলা শিখতে পারবে না। সিডনিতে যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা তাদের পিতা-মাতার কাছে শুদ্ধ বাংলা শেখার সুযোগ পায়না তারা পরবর্তীতে শুদ্ধ বাংলা বলা হয়ে উঠে না। আর যদি লজ্জায় আর বাংলা বলতেও উৎসাহিত না হয় তবে কিন্তু হারিয়ে যাবে প্রবাসী সন্তানদের কাছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব কারন ভাষা চর্চা না করলে যে ভাষাটাই চর্চাকারীদের কাছে মরে যায়।
আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠা থাকলে এবং যথাযথ পদক্ষেপ নিলে সন্তানদের মোটামুটি চলনসই বাংলা শেখানো সম্ভব। এক্ষেত্রে পিতামাতাকে সচেতনভাবে পারিবারিক পরিবেশে বাংলার চর্চা করতে হবে। আঞ্চলিকতা বাদ দিয়ে শুদ্ধ চলিত বাংলায় সন্তানদের সাথে ঘরে নিয়মিত কথা বললে তারা তখন অন্য বাঙ্গালী ছেলেমেয়েদের সাথে বাংলা কথা বলার সমস্যায় পড়বেনা।
কামরুল ইসলাম
প্রধান সম্পাদক
আপনার মতামত লিখুন :