দীনতা আসলে কোথায়?


নিউজ ডেক্স প্রকাশের সময় : মে ২৬, ২০২৩, ৫:২৫ পূর্বাহ্ন
দীনতা আসলে কোথায়?

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমেরিকার ভিসা বন্ধ সংক্রান্ত একটা খবর ভেসে বেড়াচ্ছে ফেসবুকে। এই খবর দেখে সকল পক্ষই উদ্বেলিত বিহ্বল। তারা এইবার আশায় বুক বেধেছে বাংলাদেশে একটা ফেয়ার নির্বাচন হবে। কারন আমেরিকা ধমক দিয়েছে। আর এই উদ্বেলিত বিহ্বল মানুষের তালিকায় লম্বা লাইনটা সার্টিফিকেট ওয়ালা মানুষেরা, যাহাদের আমরা শিক্ষিত বলি।

আমেরিকার এই ধমকে বাংলাদেশে ফেয়ার নির্বাচন হউক বা না তাহাতে কিচ্ছু আসে বা যায় না তবে, লেখা পড়া করে পাস দেওয়া মানুষের উপনিবেশিক মানসিকতা প্রকট ভাবে উন্মোচিত হয় এবং সামনে আসে।
না বাংলাদেশ আমেরিকার উপনিবেশ ছিল না কখনোই বরং উপনিবেশ ছিল ব্রিটেনের। সেই ব্রিটেন আমেরিকার কথায় হেলে দোলে সুতরাং প্রভুর প্রভু আমাদের মহা প্রভু তার পদলেহন, তার আজ্ঞাবহ হওয়া আমাদের কর্তব্য।

কৃষক, কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে, মজুর, কুলি, রাখাল, বাউল অর্থাৎ খেটে খাওয়া মানুষের কোন হেলদোল নেই এই খবরে। এই হেলদোল না থাকার পেছনের কারণকে আমাদের সার্টিফিকেটধারিরা উন্নাসিকতা বা বোকামি হিসাবে বিবেচনা করে। তাদের পাস মারা সেই উপনিবেশিক শিক্ষার কারণে আসল রহস্য টা কি তা তাহাদের সামনে আসে না। খেটে খাওয়া মানুষের এই গা ছাড়া ভাবটা বুঝতে বা ধরতে যে আক্কেল জ্ঞান বা কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োজন হয়, তা আমাদের সার্টিফিকেট হাতে ধরা শিক্ষিতদের নেই।

প্রতি দশ বার মাইল পর পর বাংলাদেশের মাতৃ ভাষার একধরনের বদল দেখা যায়, সকলের ভাষাই বাংলা কিন্তু মজার বিষয় হল এক এলাকার বাংলা ভাষার সাথে আরেক এলাকার বাংলা ভাষার প্রচুর অমিল। কেন এমনটা হয়? এমনটা হবার পেছনের কারন-ই বা কি?

বাংলাদেশের মানুষ ছিল স্বয়ং সম্পূর্ণ । তারা নিজেদের এলাকায় সকল কিছু উৎপন্ন করত বলে তাদের চলাচল গমনা-গমন বিয়ে শাদি আত্মীয়তা সকলই ছিল একটি নির্দিষ্ট এলাকার ভেতরে সীমিত। আর যে সকল জিনিষ উৎপাদন করতে পারত না তার জোগান দিত সাপ্তাহিক হাট বা মেলা। তাই খেটে খাওয়া মানুষগুলি আমেরিকা কি বলল বা করল সেই দিকে খেয়াল দিবার সময় বা সুযোগ পেত না এবং এখনও খেয়ালে নেয় না। তারা জানে তাদের এলাকার ভাল মানেই – সব ভাল। প্রয়োজনে তারা পাশের এলাকার পাশে দাঁড়াতে পারবে।

বাংলাদেশে উপনিবেশিক শিক্ষার আগমনের সাথে সাথে সার্বজনীন ভাষা শিক্ষার একটা প্রভাব পড়েছে প্রকট ভাবে। যা শিক্ষিতরা খুব ধারন এবং বহনের ভান করে। আর এই প্রভাব টা মূলতই মুনাফা কেন্দ্রিক। শিক্ষিতরা প্রথমে ভেবে নেয় ‘কাজটা করলে আমার লাভ কি’? তারা ভাবতে পারে না কাজটা করলে আমাদের এলাকার মানুষের অথবা দেশের মানুষের লাভ কি?

অথচ আমাদের দেশের শিক্ষিতরা আইএলটিএস জিআরই টোফেল মেলা মেলা কোর্স করে আমেরিকা পাড়ি দিবার জন্য। কারন এই যে, আমেরিকার মানুষেরাও আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে তাদের সেই ভাষার সাথেই কমিউনিকেট করবার শিক্ষাটা তাদের নিতে হয়। মজার বিষয় আমেরিকায় এমন ভাষা বৈচিত্র্য থাকলেও নীতি, মানবিকতার বৈচিত্র্য নেই বললেই চলে। কিন্তু আমেরিকায় কি ঘুষ দুর্নীতি খুন রাহাজানি নাই?

বাংলাদেশে এক বিবাহ বিচ্ছেদ আইনই অনেক গুলা। জমির মালিকানা আইনও তদ্রূপ। শিক্ষার বিষয়টা আমরা নিজেরাই চোখে দেখি। মাদ্রাসা শিক্ষাও একরূপ নয়।

সুতরাং ফেয়ার নির্বাচন না হলে বাংলাদেশের ভিসা বন্ধ করে দিবার প্রসঙ্গে আমেরিকার হুমকিতে খেটে খাওয়া মানুষের তেমন হেলদোল হবার কথা নয়। কারন তারা জানে, সুস্থ থাকলে তারা খেটে তাদের সকল নিত্য প্রয়োজনীয় বিষয় উৎপন্ন করতে পারে এবং তারা সচ্ছল নির্বিবাদ একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। হাসি তামাশা আনন্দ সহকারে সকলের সাথে মিলে মিশে। হয়তো তাদের এই জীবন তথাকথিত ইট পাথর লোহার স্থাপনা সমৃদ্ধ কৃত্রিমতা পূর্ণ উন্নয়নের জীবন না।

যারা রাজনীতি করছেন যারা দেশটাকে উন্নত দেশে পরিণত করতে চাইছেন তারা এই খেটে খাওয়া মানুষগুলিকে অনুশীলন করে – তাদের শান্তি কিসে, সুখ কিসে, প্রশান্তি কিসে সেটি খুঁজে দেখুন। তাদের প্রমিতে বেঁধে রাখবার তাদের কঠোর কঠিন নিয়মে শৃঙ্খলিত করে মানুষ গড়বার বাসনা বাদ দিন। তাত্ত্বিক টার্মে বেঁধে ফেলবার বাসনা ত্যাগ করুন।

যে জবাবদিহি হীন ক্ষমতা তান্ত্রিক পদ্ধতির ভেতর দিয়ে মানুষকে মানুষ করে গড়ে তুলবার বাসনা করছেন আসলে সেটি লুটপাট পাচার শোষণ শাসনের বাসনা। ক্ষমতাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনুন। মানুষকে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করে তার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বিনোদন এর স্বাধীনতা দিন। এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করুন যে রাষ্ট্র এই ছয়টি বিষয়ে স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে।

নিজের দেশটা গুছিয়ে নিন। বাংলাদেশকে নিয়ে গর্ব করবার পরিকল্পনা করুন। আপনাকে আমেরিকা, ইউরোপ, রাশিয়া, চীন, জাপান এমন কি ভারতের বদান্যতার দিকে, করুণার দিকে, উচ্ছিষ্ট ছুঁড়ে দিবার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতে হবে না। দেখবেন উন্নত ধনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এমনিতেই আপনার পায়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

আদীল হোসেন
লেখক ও বিশ্লেষক

ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন: