অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য রোডম্যাপ নির্দিষ্ট করার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, জনগণের নির্বাচিত সরকারই কেবল পারে গণতন্ত্র ও দেশে উন্নয়নের নতুন ধারা সৃষ্টি করতে এবং মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিতে।
তিনি বলেন, এই সরকারের প্রতি সেদিনও আমাদের সমর্থন ও আস্থা ছিল, আজও আছে। তবে এখানে একটি কিন্তু রয়েছে। তাদের প্রতি আমাদের আস্থাকে প্রশ্নহীন রাখার চ্যালেঞ্জ কিন্তু তাদেরই নিতে হবে। স্বৈরাচার পতনের এই মহাসময়ে দেশের গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দল, ছাত্র-জনতা, কৃষক, শ্রমিক ও সর্বস্তরের মানুষের অবদানকে যদি আমরা মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হই, তাহলে ১৬ বছরের স্বৈরাচারী হাসিনার গুম, খুন, হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার জনতার অবদানকে যদি স্বীকৃতি দিতে না পারি, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
তিনি বলেন, স্বৈরাচারের ফেলে যাওয়া যে দলবাজ উচ্ছিষ্ট প্রশাসনের চলমান ষড়যন্ত্রের কাছে কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার মাঝে মাঝে অসহায় এবং বিপর্যয় বোধ করে।
শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ঝিনাইদহের পায়রা চত্বরে ফ্যাসিবাদী আন্দোলনে ঢাকায় নিহত ঝিনাইদহের সাব্বির ও প্রকৌশলী রাকিবুল হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে ভার্চুয়ালি প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তারেক রহমান।
তিনি এদিন ভার্চুয়াল সমাবেশে যুক্ত হয়ে ১১ মিনিট বক্তব্য দেন। ১৬ বছর পর আয়োজিত বিএনপির এই সমাবেশটি জনসমুদ্রে রূপ নেয়। জেলার সব উপজেলা, এমনকি পাশের জেলার নেতাকর্মীরাও সমাবেশে যোগ দেন।
ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সভাপতি এমএ মজিদের সভাপতিত্বে সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক জয়ন্ত কুমার কুন্ডু, সহ-তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক আমিরুজ্জামান খান শিমুল, মীর রবিউল ইসলাম লাভলু, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুজ্জামান মনা ও মুন্সি কামাল আজাদ পাননু প্রমুখ বক্তব্য দেন।
তারেক রহমান বলেন, আমরা আজ এমন একটা পরিবেশে সমবেত হয়েছি যেখানে কারো কোনো ভয় নেই। সবাই আমরা শংকামুক্ত পরিবেশে একত্রিত হয়ে কথা বলছে পারছি। আমরা আমাদের কথা বলার জন্য একই সঙ্গে আমরা অন্যের কথা শোনার জন্য একত্রিত হয়েছি। অথচ মাত্র ক’দিন আগেও এ দেশের মানুষ দল-মত নির্বিশেষে কথা বলতে পারত না। বিগত ১৬ বছর ধরে আমরা আমাদের কষ্টের কথাও স্বাধীনভাবে বলতে পারতাম না। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল দেশের মানুষ। কিভাবে বাংলাদেশের মানুষের অধিকারগুলো ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তাদের ন্যায্য অধিকার হরণ করা হয়েছিল। ঝিনাইদহ জেলায় জাতীয়তাবাদী দলের অনেক নেতাকর্মী আছেন যাদের আমরা হারিয়েছি। মিরাজুল, দুলাল ও পলাশসহ বহু মানুষকে হারিয়েছি। ফ্যাসিস্ট সরকার পতনেও এই জেলার মানুষ সাব্বির ও প্রকৌশলী রাকিবুল বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে। দেশের মানুষ গত ৫ আগস্ট এই স্বৈরাচার সরকারকে বিদায় হতে বাধ্য করেছে।
তিনি বলেন, জনগণের আন্দোলনের মুখে যে স্বৈরাচার জনগণের বুকের ওপর চেপে বসেছিল, সেই স্বৈরাচার পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই কৃতিত্ব বাংলাদেশের সব মানুষের। আজকে যখন স্বৈরাচার পালিয়ে যাওয়ার পর আমাদের দাবি ছিল দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সৃষ্ট শূন্যতা পূরণের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। এই সরকার সবার সমর্থন নিয়েই এসেছে। সঙ্গত কারণেই তাদের প্রতি আমাদের সমর্থন ছিল এবং থাকবে। তবে এখানে একটি কিন্তু আছে। তাদের প্রতি আমাদের আস্থাকে প্রশ্নহীন রাখার চ্যালেঞ্জ সরকারকেই নিতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য রোডম্যাপ নির্দিষ্ট করতে হবে।
তারেক রহমান বলেন, বাস্তবতা বিবেচনায় বুঝতে হবে যে, সব পরিবর্তন সাধন তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তেমনি এমন দায়িত্ব কাঁধে নেওয়া উচিত হবে না যেটি তারা বহন করতে পারবে না। যে দায়িত্ব তারা পালন করতে সক্ষম তাতে আমাদের সমর্থন থাকবে। তিনি বলেন, স্বৈরাচারের ফেলে যাওয়া যে দলবাজ উচ্ছিষ্ট প্রশাসনের চলমান ষড়যন্ত্রের কাছে কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার মাঝে মাঝে অসহায় এবং বিপর্যয় বোধ করে। এর অবসান না হলে এদের বেড়াজালে আবদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকার ছোট ছোট বিপর্যয়কে একসময় মহাবিপদ হিসেবে নিজেদের সামনে দেখতে পাবেন এবং তখন প্রতিকারের পথ হয়ে যাবে সংকীর্ণ।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বুঝতে হবে বৈদেশিক বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক বিশ্বের আস্থা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও ব্যবসা বাণিজ্যে স্বস্তি, জনগণের নিরাপত্তা, দেশ এবং জনগণের যে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা, তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের নিরাপত্তাসহ প্রাত্যহিক সুবিধা সবকিছুই কিন্তু দিতে পারে একমাত্র জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার। এই বিষয়গুলো ফিরিয়ে আনতে হলে নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই।
তারেক রহমান বলেন, গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার যে মহাবিপ্লব বা জনগণের সফলতা আমাদের সামনে আরেকটি নতুন বিজয়ের বার্তা নিয়ে এসেছে। স্বৈরাচার পতনের এই মহাযুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মর্যাদা দিতে আমরা যদি ব্যর্থ হই, গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে না পারলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। গত ১৭ বছরে বিশেষত জুলাই-আগস্টে যে মানুষগুলো আন্দোলনে গিয়েছে, যে মানুষগুলো সবকিছু উজাড় করে দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করেছেন, আমাদের ভবিষ্যতের জন্য জীবনবাজি রেখে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদের এই আত্মত্যাগ সেদিনই সফলতা লাভ করবে, যেদিন এ দেশের মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে তাদের অধিকার ফিরে পাবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হবে। সেদিনই আমাদের এই আন্দোলনের শহীদ এবং ৭১-এর শহীদদের এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন এবং যারা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগ সফলতা লাভ করবে। আজ আমাদের সেই প্রতিজ্ঞা নিতে হবে, বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে হবে একটি স্বাভাবিক পথে, যা দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে।
তারেক রহমান আরও বলেন, দল-মত নির্বিশেষে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা প্রত্যাশা করে। প্রতিটি শিশু, প্রতিটি শিক্ষার্থী নিরাপত্তা ও শিক্ষাগ্রহণের যে গ্যারান্টি চায়, প্রতিটি কৃষক তাদের অবদানের যে স্বীকৃতি চায়, এসব কিছু সরকার গঠনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তারেক রহমান দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করে তার বক্তব্য শোনার জন্য ঝিনাইদহের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেন, আসুন, আমরা আন্দোলন করে, সংগ্রাম করে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছি। আমরা জনগণের প্রত্যাশা পূরনে কাজ করি। আসুন আমরা বৈষম্যহীন সুখি-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে ঐক্যবদ্ধ হই।
আপনার মতামত লিখুন :