ছোটবেলায় ভাদ্র মাসের ভরা বর্ষায় পরীর দীঘির পাড়ে তাল কুড়াতে যেতাম প্রায়ই সন্ধ্যাবেলায়! যে দিন বৃস্টি হতো দল বেধেঁ তাল কুড়াতে রওনা দিতাম রানু বুবুর সাথে। আমাদের বাড়ির পূর্ব পাশের দিগন্তের মাঝামাঝি দীঘির উচু ডিবিটা অনেক দূর থেকেই দেখা যেত। ডিবিটার উপর তালগাছ ছাড়াও ছিল খুবই পুরোনো আম গাছের জঙ্গল, বর্ষা কালে নানান গুল্ম জন্মে ঘন হয়ে থাকত। আষাঢ় ভাদ্রে চারদিকে তখন নতুন রোয়া ধান গাছ আর খোলা জমি। আইল ছাড়া শুধু পানি আর পানি। ডুবু ডুবু আইল গুলো সগৌরবে ডাঙার জানান দিত। ভরা বর্ষার পানিতে ছোট ছোট ধানের চারা গুলো অসহায়র মতো মাথাটা উঁকি দিয়ে দাড়িয়ে থাকত। দেখে মনে হতো জমির আইলে কে যায় তা একটু পরখ করে দেখার চেষ্টায়রত ধানের চারাগুলো।
রানু বুবু তখন ক্লাস টেনে ।দলে ছিলাম আমি আর দুই চাচাত ভাই। আমরা তিনজনই তখন প্রাথমিকে পড়ি। রানু বুবু ছিল লিডার টাইপ, আমাদের পড়ানো, হোমওয়ার্ক তৈরি ,স্কুলের খোঁজ খবর রানু বুবুই রাখত, সেই সাথে মাঠে ঘুরে বেড়ানো, ঘুড়ি উড়ানো, দোয়েল, বুলবুলি কিংবা টুনটনির বাসায় হানা দেওয়া সহ দীঘির জলে সাঁতার কাটা সব কাজেই রানু বুবু দুরন্ত চপলা।
দীঘির পাড়ের আম গাছটা নিয়ে নানান কথার প্রচলন ছিল, রানু বুবু প্রায়ই আমাদের গল্পগুলো বলত। শুনতাম দীঘির পাড়ে ঐ আম গাছটায় এক পরীর বসবাস। পরীটা নাকি প্রায়ই দীঘির পাড়ে ঘুরে বেড়ায়, মাঝে মাঝে আম গাছ থেকে রান্না করা পোলাও পোলাও গন্ধ আসত, রানু বুবু বলত আজ পরীটা পোলাও রান্না করছে। ঐ পরীটাকে নিয়ে তখন আশেপাশে অনেক গল্পের ডালপালা ছিল! আমরা ভয় পেলে রানু বু বলত
– আরে ভয় পাইস না।
পরীটা ভাল মানুষের কোন ক্ষতি করেনা।
একবার এক চৈত্র মাসের দুপুর বেলা আমাদের গ্রামের কুদ্দুস পালওয়ানের লাশ পাওয়া গেল দিঘির ধারে, লাশের নাকে মুখে শুধু ফেনা বেরুচ্ছিল। কুদ্দুস খুবই মোটাসোটা ছিল, খুবই বাজে স্বভাবের, কারনে অকারনে বৌটাকে মারত। তাই রানু বুবু ওকে দুই চোক্ষে দেখতে পারতনা। বুবু বলল, -জানস আমার মনে হয় ঐ পরীটাই কুদ্দুস পালওয়ানকে ঘাড় মটকে দিসে।
আমি বললাম কেন গো বুবু?
– কারন ও খালি বউ মারে! পরীটা খারাপ মানুষ দেখতে পারেনা।
পরীটার ভয়ে দীঘির পাড়ে একা একা যেতামনা কখনো! কিন্তু পাকা তালের লোভ সামলাতে পারতাম না। তাই দল বেধেঁ যেতাম, হাতে থাকত লাঠি, হারিকেন আর বড় একটা লোহার রড। রানু বু বলত লোহাকে রাখিস, ভুত প্রেত লোহা দেখলে ভয় পায় ।
একদিন স্কুল থেকে ফিরলে দেখলাম বাড়ি ভর্তি অচেনা মেহমান, সবাই মিস্টি মুখ করছে। আমাকে দেখে ছোট চাচা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করল রানু কইরে? বললাম বুবুর স্কুল ছুটি হতে আরো আধ ঘন্টা বাকি!
আমি বই রেখে পাকঘরে গিয়ে দেখি বিরাট আয়োজন, সবাই রান্নাবান্না করছে!
জিজ্ঞাসা করতেই একজন বলে উঠল –
রানু কে দেখতে আসছে, ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে।
রানু বুবু স্কুল থেকে ফিরলেই সবাই ফিসফিস সরগোল শুরু করল।
পাত্র পক্ষের বুবুকে পছন্দ হয়েছে, এখন একটা শুভ দিন দেখে বিয়ের তারিখটা পাকা হয়ে গেলেই তারা বাচেঁ।
রানু বুবুর কান্না দেখে বড় চাচা সময় চাইলেন, কিন্তু পত্র পক্ষের হাতে সময় নাই, ছেলের বাবা বলল দেখেন শুভ কাজে দেরি করা ঠিক না।
তারপর অগ্রাহায়ন মাসের কোন এক সন্ধ্যায় রানু বুবু বউ সেজে বিদায় নিলো ..
বুবুর বিদায়ে সবচেয়ে একা হয়ে গেলাম আমি! বুবুই একমাত্র বন্ধু ছিল আমার।
রানু বুবুর শশুর বাড়ি ছিল পাশের গ্রামে।প্রায়ই স্কুল ছুটির পর কাউকে না বলে বুবু কে দেখতে চলে যেতাম। বুবু আমাকে দেখে খুশি হতো, মাঝে মাঝে কান্নাও করত। ফিরে আসার সময় দিগন্তে অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত বাড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকত।
বিয়ের কয়েক মাস পর পৌষমাসে বুবু ন্যাইওর আসল আমাদের বাড়িতে, সে কি খুশি হয়েছিলাম আমি! কিন্তু বুবু কেমন যেন আগের মতো নাই। মন খারাপ করে থাকত, ফিসফিস করে মা কে আর দাদীকে কিকি যেন বলত ! লুকিয়ে কান্না করত। আমি ঠিক বুঝতাম না তারপরও তার ঐ মলিন মুখটা দেখে আমার মন খারাপ হতো।
একদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনি রানু বু শশুরবাড়ি চলে গেছে! সেদিন প্রচন্ড অভিমান হলো। মনে মনে বললাম বুবু যখন না বলে চলে গেছে আমি তাকে আর দেখতে যাবনা, কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে দুই দিন পরই দেখতে গেলাম। সেদিনআমি আতকেঁ উঠলাম। বুবুর চোখ আর মুখের একপাশ ফুলে রক্ত জমাটের মতো কালো হয়ে আছে। বুবু কান্না করছিল, কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই বলল –
পুকুর ঘাটে পড়ে ব্যাথা পেয়েছি !
বুবু অসুস্থ হয়েছে শুনে বড় চাচা পরদিন বিকেলে গেলেন দেখতে। সন্ধ্যায় দেখি বুবুকে নিয়ে বড় চাচা বাড়িতে হাজির! বাড়িতে উচ্চ স্বর, মুরব্বিদের বৈঠক, মৃদু কান্নার আওয়াজ। আমি কাচারী থেকে বেরিয়ে বৈঠক খানায় উকিঁ দিলাম – দেখি মুরব্বিরা ক্রোধে ঝাড়ছে, আর রানু বুবু মুখ চিপে কান্না করছে। জানলাম বুবু ভাল নাই, মারধর করে, শাশুড়িও যথেস্ট কষ্ট দেয়। তার চোখ মুখ ফুলে যাওয়ার কারন তার স্বামী।
মাস খানেক গড়িয়ে গেল রানু বুবু আমাদের বাড়িতে থাকছে, আর আস্তে আস্তে ট্রমাও কাটিয়ে উঠছে। সেই আগের মতো আমাদের নিয়ে বেশ ব্যাস্ত হয়ে গেলেন, রানু বুবুর মুখে হাসিও ফুটেছে! কিন্তু এক অজানা ভয় পেত মাঝে মাঝে। একদিন হাটতে হাটতে বলল –
আমি আর ঐ বাড়িতে ফিরে যাব না, মরে গেলেও না। বাবা কে বলে দিয়েছি!
আমি বললাম, বুবু আমিও চাই তুমি ঐ শয়তানটার বাড়িতে যেওনা।
বুবু বলল – দেখিস আমি কিছুতেই যাব না।
এই ভাবে কয়েক মাস কেটে গেল , আবার সেই ভাদ্রমাসে পাকা তালের সিজনে তাল কুড়াতে ছুটতাম বুবু সহ মহা আনন্দে! একদিন তাল কুড়ানোর সময় বুবু বলল, পরীটা যদি আমার জামাইটা কে একটা শাস্তি দিতো আমি খুবই খুশি হতাম বলেই বুবু হেসে দিল, আমরাও হাসলাম বুবুর সাথে ..
কয়েক মাস কেটে গেল ; আশ্বিন মাস ছুই ছুই । সন্ধ্যা হলেই চারদিকে মৃদু কুয়াশার ভাব । ডুবন্ত সেই ধানের চারা গুলো এখন পূর্ন যুবতী। যে কোন সময় ধানের ছড়া বেরলো বলে। তালের সিজনও প্রায় শেয! একদিন দুপুরে রানু বুবুর শ্বশুর বাড়ির লোকজন হাজির।
তারা বুবু কে ফেরত নিতে এসেছেন, অতিতের ভূল গুলোর জন্য ক্ষমা চেয়ে আর একবার সুযোগ চাইলেন। কিন্তু রানু বুবু অনড়, কিছুতেই যাবেননা। কিন্তু তাদের কথায় বড় চাচা মোটামুটি একটা সুযোগ দিতে চাইলেন। রানু বুবু চিৎকার দিয়ে বললেন আমি মরে গেলেও ঐ বাড়িতে যাব না। বুবুর চিৎকারে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। রানু বুর শশুর দুই দিনের সময় নিয়ে চলে গেলেন।
পরদিন দুপুর থেকে ভাদ্রমাসের ঝুমবৃস্টি। সকালে রানু বু কে দেখলাম আনমনে বসে আছে, আমার দিকে অপলক তাকিয়ে বলল, স্কুলে যাস নি এখনো । বললাম এই তো যাচ্ছি-
স্কুল থেকে ফিরে রানু বু কে দেখলামনা! সবাই তাকে খুজেঁ হয়রান। এদিকে প্রচন্ড বৃষ্টির বাহিরে যাওয়াও মুশকিল। সবাই ভাবল রানু বুবু হয়ত নানাবাড়ি গিয়েছে কাউকে না বলে, অভিমান করে আগে বুবু প্রায়ই এই কাজ করত ।সকালে খুজঁবে বলে হালকা ভাবেই নিল সবাই।
সন্ধ্যার পর বৃষ্টির ধারা কমে গেছে, কিন্তু গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল! আজ তাল কুড়ানোর কোন তাড়া নাই! হটাৎ চাচাতোভাই কে বললাম চল তাল কুড়াতে যাই।
দীঘির পাড়ে যেতেই হটাৎ দমকা হাওয়ায় কুপি নিভে গেল হাতে থাকা টর্চ্টাও পুরোনো ব্যাটারির দূর্বলতা কাটিয়ে আলো বিকিরণের নিরন্তর চেস্টা করেই যাচ্ছে কিন্তু বেশী কিছু করতে পারছে না। দমকা হাওয়া আর টিপ টিপ বৃষ্টিতে লক্ষ্যকরলাম আধারেরও একটা অদ্ভুত আলো আছে। দীঘির পাড়ের পাশে এক ঝাক জোনাকি উড়ছে, অসীম আকাশের তারাগুলো যেন অবাক বিস্ময়ে দেখছে আমাদের আর মিটিমিটি হাসছে। আমি টর্চ্টা নিভিয়ে কিছুক্ষন দাড়িয়ে ভয়ংকর সেই সৈন্দর্য উপভোগ করছিলাম। চাচাতো ভাইর ডাকে সম্মোহনী ফিরে এলো।
দীঘির পাড়ে গিয়ে দেখি অনেক গুলো তাল পড়ে আছে কাদার মধ্যে। তাল গুলো হাতে নিতেই, আম গাছ থেকে গন্ধগোকুলের তীব্র ঝাঝালো গন্ধ নাকে এসে লাগল , চোখ পড়ল আম গাছটার দিকে, আমি হতচকিত হয়ে দেখলাম দুটো পা ঝুলছে, একটু আলো বাড়িয়ে দেখি রানু বু ঝুলছে ; মনে হলো পরী বুড়িটাই উপর থেকে টেনে ধরে রেখেছে বুবু কে ! আমি ভয়ে অস্থির হয়ে দৌড়ে বাড়ির উঠোনে গিয়ে চিৎকার দিয়ে রানু বুবু কে পরীটা নিয়ে যাচ্ছে বলেই জ্ঞান হারালাম!
সকালে যখন জ্ঞান ফিরল দেখি বাড়ি ভর্তি অচেনা লোকের কথাবার্তা আর গুমোট কান্নার আওয়াজ, আত্মীয় স্বজনদের আনাগোনা! বিছানা ছেড়ে দুরু দুরু পায়ে দরজা ধরে উঠোনের দিকে তাকালাম, কয়েকটা পুলিশ বসে আছে এক কোণে আর উঠুনের সামনে নিথর একটা দেহ পড়ে আছে সাদা চাদরে ঢাকা।
তারেক ইসলাম
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
2021-03-07 15:46:03
আপনার মতামত লিখুন :