ত্রিভূজ প্রেমের চতুস্কোন


অনলাইন ডেক্স প্রকাশের সময় : মার্চ ৭, ২০২১, ৩:৫২ অপরাহ্ন
ত্রিভূজ প্রেমের চতুস্কোন

নীলা এলোমেলো ভাবে হাটঁতে লাগলো, মন ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হবার কথা আগে শুনেছে কিন্তু সত্যিই যে তাই হয় তা কে জানতো।একেবারে বাস্তব অভিগ্যতা ; ভার্সিটি থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে । রিক্সা থেকে বাসার সামনে নেমে ও সে সামনের দিকে হাটতে শুরু করলো;সামনে রাস্তাটা অন্ধকার হয়ে আসছে ; কেমন যেন ভৌতিক লাগছে চারদিক। খিলগায়ের নিজের বাসা ছাড়িয়ে আরো সামনের দিকে এগোতে লাগলো নীলা; এদিকটা খুব নির্জন বেশ কয়েকটা ঝুপরি ঘর পেরিয়ে আরো সামনে অন্ধকারের দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে এলোমেলো হাটঁতে লাগলো।সামনে বেশ খানিকটা দূরে অনেকগুলি বখাটে টাইপের ছেলে জটলা করে দাড়িয়ে আছে। নীলা বুঝতে পারছে আর এগোনো ঠিক হবেনা ; তার ষষ্ঠইন্দ্রীয় তাকে বাধা দিতে লাগলো। সে হঠাৎ থমকে দাড়ালো , না; এসব সে কি করছে ? কেন করছে? ফিরে যাওয়া উচিত এখনই ।
নীলার যখন পনেরো ষোল বছর তখন থেকেই নীলাকে পচ্ছন্দ করে মানে ভালোবাসে পাশের বাসার বাবু ভাই । নীলার ও ভালোলাগে বাবু ভাইকে, স্কুলে আসা যাওয়ার পথে প্রায়ই দেখা হত চোখাচোখি হত তাদের।বাবু ভাই বইয়ের পাতার ফাকে প্রেম পএ গুজে পাঠিয়ে দিত তার ছোট বোনকে দিয়ে । সেই প্রেম পএ খুব মন দিয়ে পড়তো নীলা; অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করতো।নীলাদের বাড়ীতে খুব কড়াকড়ি শাসনের কারনে কখনো কখনো চিঠিগুলি পড়েই কুচিকুচি করে ছিড়ে ফেলতো নীলা মায়ের ভয়ে ; বড় ভাইয়ের ভয়ে।তবুত্ত মনে মনে ভালোবাসা বাসি কি আর আটকে থাকে শাসনের ভয়ে; কোনদিন ছাদে কয়েক মিনিটের জন্য লুকিয়ে দেখা হত নীলার বাবুর সাথে ; চিলেকোঠায় একদিন বাবুকে কথা দিয়েছিলো নীলা বড় হয়ে বাবুকেই বিয়ে করবে; অপেক্ষা করবে আজীবন।
হায় জীবন! কি ভেবেছিলো তারা আর কি হল। আজ সাত বছর পরে বাবু ভাই আমেরিকায়; বাবুর পরিবার পরিজনেরা নীলার সাথে সম্পর্ক টের পেয়ে বাবুকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দিয়েছিল । আর নীলা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাষ্টারস্ করছে এ্যকাউনটিং এ।এদিকে সুমন নামের এক সহপাঠী নীলাকে পচ্ছন্দ করে সেই প্রথম বর্ষ থেকে; নীলা খুব একটা পাত্তা দিতনা কখনোই । সে জানে সে সুন্দরী; চোখে পরার মত তার গড়ন আর মুখশ্রী। দুচারটে ছেলে তো ঘুরবেই চারপাশে।সুমন তাকে ভালোবাসার কথা বলেছে সুযোগ পেলেই কিন্তু নীলা যে বাবুকে কথা দিয়েছে বহু আগে, কেমন করে ভাঙবে সেই প্রতিশ্রুতি।বাবু ও তো তাকে পাগলের মত ভালোবাসতো।সুমনের ডাকে সে সারা দিবে কি করে,কিন্তু কোথায় বাবু আজ সাত বছর তো সে দেশেই ফেরেনি।
কি নিয়ে যেন ভাবছিলো! নীলার মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠে; না আর ভাবতে চায় না সে। চারদিক পুরো অন্ধকার হয়ে গেছে, চট করে পিছু ঘুরে প্রায় দৌড়াতে থাকে সে বাসার দিকে।বাসায় দ্রুত ঢুকতেই মায়ের মুখোমুখি পরে গেলো
মা ভীত গলায় বল্লেন কি হল এত দেড়ী যে ! আমি চিন্তায় বাচিঁনা।
নীলা না মা , রাস্তায় খুব জ্যাম ছিল তাই আটকে ছিলাম ।
মা তাড়াতাড়ি খেয়ে নে , গছুল করবি? গরম পানি করে রেখেছি।
নীলা হুম করবো , দিতে বল গরম পানি।
নীলা কোনরকম একটুখানি খেলো , কিছুই ভালো লাগছে না তার। মনে অজানা অচেনা একটা আশংকা। তবে কি স্বর্ণালী সুমনকে পচ্ছন্দ করে ? স্বর্ণালী নীলার খালাতো বোন , নীলাদের নীচের তলায় স্বর্ণালীরা থাকে বাসা ভাড়া করে।নীলার ছোট খালার মেয়ে স্বর্ণালী শ্যামবর্ণ কিন্তু খুবই লাবণ্যময়ী চেহারা তার।কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে সে।মাস ছয়েক আগে নীলার বড় বোন শীলার বিয়েতে বন্ধুদের সবাইকে দাওয়াত করেছিলো নীলা । বন্ধুরা সবাই মিলে নীলাকে অনেক সহযোগিতা করেছে হলুদের কেনাকাটা থেকে শপিং , কার্ড বিলি সব ব্যপারে, তেমনই আড্ডাবাজী ও চলেছে একনাগারে।স্বর্ণালী আর রাফান দুই ভাই বোন ও মহা উৎসাহে সব কাজে হাত লাগিয়েছে।সব বন্ধুদের সাথে সুমন ও এসেছিলো; তখনই স্বর্ণালীর সাথে পরিচয় সুমনের সবার সাথে; একটা দম আটকানো যন্ত্রনা হতে থাকে নীলার।নীলা জানতো সেই প্রথম থেকেই সুমন তাকেই ভালোবাসে, যতকিছুই হোক সুমন শুধু তাকেই চায়, আর কিছু না, পৃথিবীর কোন মেয়েকে চায় না সুমন। আজ তবে কেন মনের কোনে এক অজানা আশংকা; ভার্সিটির বাসে করে আসছিলো কালকে নীলা আর পথেই এক রিক্সায় পাশাপাশি সুমন আর স্বর্ণালীকে দেখেছে সে।মাথাটা সত্যিই কেমন যেন করছে নীলার; বারান্দায় অন্ধকারে এসে বসে সে .. বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে ।
এদিকে সদ্য কৌশর পেরোনো স্বর্ণালীর মনে দোলা দিয়েছে সুমন।প্রথম দেখাতে সাদাসিধে সুমনকে দেখেই মন হারিয়েছে স্বর্ণালী, নীলা আপার সাথে এক সঙে ভার্সিটিতে পড়ে সুমন ভাই ;নীলা আপাকে ভালোবাসে সুমন ভাই সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই জানে স্বর্ণালী।কিন্তু নীলা আপার সাথে তো বাবু ভাইয়ের প্রেম সেই ছোটবেলা থেকে।মন থেকে সুমনকে ভালোবেসে ফেলেছে স্বর্ণালী প্রথম দেখাতে। কিছুতেই বুঝতে পারছেনা কি করে বলবে সুমনকে; অনেক কষ্ট করে সুমনের মোবাইল নাম্বার যোগার করেছে স্বর্ণালী।এরপর বাসার পাশের মোবাইলের দোকান থেকে ফোন করে কথা হল একদিন। তার কিছুদিন পরেই ছিলো স্বর্ণালীর জন্মদিন । সুমন জানতো স্বর্ণালীর জন্মদিন সেদিন; বিকেল বেলা বাসায় আসতে চায় জানিয়েছিলো স্বর্ণালীকে ল্যান্ডফোনে ফোন করে।স্বর্ণালী বিকেলে দরজা খুলে দেখলো সুমনের হাতে ছোট্ট একটা প্যাকেট ; বসতে বললো ড্রইং রুমে।হালকা চা নাস্তা দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করলো, স্বর্ণালীর মা এসে ও টুকটাক কথা বললো সুমনের সাথে।স্বর্ণালীর মা চলে যাওয়ার পর স্বর্ণালীর দিকে প্যাকেটটা এগিয়ে দিলো সুমন । বললো এটা তোমার জন্য, স্বর্ণালী হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিলো প্যাকেটটা নেবার সময় স্বর্ণালীর হাত কাপঁতে লাগলো; সুমন তাকিয়ে রইলো স্বর্ণালীর কম্পমান হাতের দিকে।স্বর্ণালীর বুকের ভেতর কমন যেন ড্রাম বাজতে লাগলো। ধ্বক ধ্বক ধ্বক ! সুমন পারলো স্বর্ণালীর হ্রদয়ের কম্পন; অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো সুমন। বিদায় নিয়ে চলে আসার সময়ে বিল্ডিং থেকে নামার সময় দোতালার দিকে তাকিয়া সুমন দেখলো স্বর্ণালী বারান্দায় দাড়িয়ে আছে।সুমন তাকাতেই স্বর্ণালী চোখ নামিয়ে নিলো কিন্তু চলে গেলোনা , যতদূর সুমনকে দেখা গেল ততদূর তকিয়ে থাকলো।
সুমন আর স্বর্ণালী প্রেমে মজেছে প্রায় ৯ মাস হলো,নীলার অজান্তে সেই প্রেম ডালপালা মেলেছে অনেকদূর।আজ ৯ মাস পরে আজকেই নীলা; সুমন আর স্বর্ণালীকে একসাথে রিক্সায় দেখে থমকে গেছে।অথচ নীলা সবসময় ভাবতো সুমন শুধু তাকেই ভালোবাসে; তাকেই চায়।তবে কি সবই ভূল ছিলো ? ছোটবেলার সেই বাবু ভাইকে সে কবে জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছে আর সুমনকে মনের অজান্তে ভালোবেসে ফেলেছে সে নিজে ও জানেনা।বৃষ্টি কমেছে, নীলা চুপটি করে ছাদে চলে এলো;তাদের পুরোনো ধাচেঁর দোতালা বাড়ীর ছাদে প্রচুর গাছ দিয়ে ঘেরা।আকাশে আধখানা চাঁদ উঠেছে; নীলা ছাদের এককোনে গিয়ে বসলো।
দিনের বেলা প্রচন্ড গরম পরেছিলো, সন্ধ্যার পর বৃষ্টি হওয়াতে চারদিক ঠান্ডা হয়ে গেলো; বাসায় ভালো লাগছিলো না বলে; স্বর্ণালী ছাদে আসলো। ছাদে পা রাখতেই আলো আধাঁরিতে এককোনে বসে থাকা দুহাটুর মাঝখানে মুখ লুকিয়ে থাকা নীলাকে আবছা দেখতে পেলো স্বর্ণালী।অনুভব করলো নীলা দুহাটুর মাঝে মুখ লুকিয়ে ব্যকুল হয়ে কাদঁছে। স্তব্ধ হয়ে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থাকলো স্বর্ণালী, স্বর্ণালী নীলার থেকে বছর ছয়েকের ছোট।হঠাৎ করে ঐ ছাদের মধ্যখানে দাড়িয়ে স্বর্ণালীর বয়স হঠাৎ করে ১০ বছর বেড়ে গেলো।
স্বর্ণালী বুঝতে পারলো নীলা আপা কেন কাদঁছে; বুঝতে পারলো নীলা আপা খুব দুঃখি একটা মেয়ে। ১২ বছর বয়সে বাবা হারিয়েছিলো নীলাপা; এরপর নীলার বিধবা মা মানে স্বর্ণালীর বড় খালা নীলাপা আর তার দুই ভাইকে বহু কষ্টে বড় করেছেন। ভালো যে নীলা আপার বাবা এই বাড়ীটা করে রেখে গিয়েছিলেন।না হলে হয়ত নীলা আপাদের পথে বসতে হত।আজকে এই অন্ধকার কোনে বসে মুখ লুকিয়ে যে নীলা কাঁদছে সে সুমনকে ভালোবাসে ব্যকুল ভাবে। আজই বিকালে সুমন আর তাকে এক রিক্সায় দেখেছে নীলা আপা। আর যা বুঝার বুঝেছে।স্বর্ণালীর পায়ের নিচের মাটি কেমন যেন সরে যেতে লাগলো; স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো স্বর্ণালী ছাদের মাঝখানে।
মানে কি? সুমন জিগ্গেস করলো স্বর্ণালীকে , আমি নীলার কাছে ফিরে যাব মানে? হুম যাবে; নীলা আপা ভালোবাসে তোমাকে।আর আমাকে আমার ফ্যমিলির জন্য অনেক কিছু করতে হবে।কথাগুলি এত দৃঢ়ভাবে সরাসরি বললো স্বর্ণালী যে সুমন বুঝতে পারলো আর কোন কথা বলে লাভ হবেনা। কথাগুলো বলেই স্বর্ণালী গটগট করে বের হয়ে গেলো রেষ্টুরেন্ট থেকে।আর সুমন পেছন থেকে বলতে লাগলো কি পেয়েছো; আমি কি পুতুল ? আমি কি খেলার পুতুল? স্বর্ণালী পিছু ফিরলোনা।
পাঁচ বছর পরের কথা
নীলা আর সুমনের সংসারে এসেছে নতুন অতিথি; সুরন্জনা।নীল আর সুমনের বিয়েতে স্বর্ণালী ও উপস্থিত ছিল; না তার মনের অবস্হা বর্ণনা দেয়া একেবারেই সম্ভব না।তবে স্বর্ণালী বুঝতে পেরেছিলো যে নীলা আপাকে কষ্ট দিয়ে সে কিছুতেই সুখী হতে পরবে না তাই সরে গিয়েছিলো সুমন আর নীলার মাঝখান থেকে।যদি ও পরবর্তী দুই বছর স্বর্ণালীর জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছিল ।অবশেষে বাবা মা আর ছোট ভাইটার দিকে তাকিয়ে স্বর্ণালী অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে থিতু হয়েছে বছর দুয়েক আগে।তিনমাস হল একটা ফার্মে কাজ পেয়েছে।এই ফার্মেই কাজ করে শিবলী; দারুন স্মার্ট, দারুন দেখতে ও।অফিস থেকে বেরতেই শিবলীকে দেখতে পেলো স্বর্ণালী।
শিবলী কেমন আছেন ? স্বর্ণালীকে জিগ্গেস করলো শিবলী
স্বর্ণালী এতক্ষণ ধরে এখানে দাড়িয়ে যে?
শিবলী আপনার জন্যই দাড়িয়ে আছি।
স্বর্ণালী কেন?
শিবলী ভালো লাগছে তাই।
কি গভীর আর মায়াময় কন্ঠস্বর শিবলীর
শিবলীর চোখের দিকে তাকিয়ে স্বর্ণালীর বুকের মধ্য কেমন যেন করে উঠলো; ধ্বক ধ্বক ধ্বক ।স্বর্ণালী মনে মনে ভাবে নীলা আপা ঠিকই বলেছিলো মানুষের জীবনে প্রেম বারবার আসে।
লেখকঃ মুনা মুসতাফা
সিডনী

2021-03-07 15:52:45
ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন: