মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই কবি প্রথমে বাকশক্তি এবং কিছুদিন পর তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর কবি বাকি ৩৪টি বছর কেবল তার দেহটিই বেঁচে ছিল। কবিকে সুস্থ্য করে তোলার জন্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের চেষ্টা অনস্বীকার্য। চিকিৎসার জন্য প্রথম দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বিদেশে পাঠানো না গেলেও পরে প্রথমে লন্ডনে এবং তারপর জার্মানি ও ভিয়েনায় পৃথিবীর খ্যাতিমান চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা করানো হয়। এছাড়াও ডঃ অশোক বাগচি ও ডঃ বিধান চন্দ্র রায়েরও তার চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
কবি ইফেক্টিভলি বেঁচে ছিলেন ৪৩ বছর পর্যন্তই। সেই সময়ের আগ পর্যন্তই তিনি হাজার হাজার গান, কবিতা লিখে গিয়েছেন। একই সাথে নাটক, উপন্যাসও লিখেছেন। এর বাহিরে মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসাবে কাজ করেছেন, সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেছেন, সৈনিক হিসাবে কাজ করেছেন, রেস্টুরেন্টে কাজ করেছেন, চলচিত্র পরিচালক ছিলেন। এছাড়া তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত মুজফ্ফর আহমদের সাথে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও বক্তৃতায় অংশ নিতেন। তাছাড়া এই ৪৩ বছর জীবনে তিনি প্রেম করেছেন, বিরহে ভুগেছেন। অর্থাৎ মানুষ ১০০ বছর বাঁচলেও এত বৈচিত্রময় ও কর্মময় জীবন পৃথিবীতে খুব কম মানুষেরই আছে বা ছিল। অসাধারণ। এই ৪২-৪৩ বছরের মধ্যেই ১০০ বছরের পূর্ণ জীবনের সুধা তিনি পান করে ফেলেছিলেন।
উনি একাধারে ছিলেন প্রেমের কবি, বিরহের কবি, বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি, গরিবের কবি, মানবিক কবি, মুসলমানের কবি, হিন্দুর কবি সর্বোপরি সকলের কবি। সেই সময় ভারতবর্ষে এত বড় বড় কবি সাহিত্যিক হতে পেরেছিল এখন পারছে না কেন? বিশেষ করে বাংলাদেশেতো কবি, সাহিত্যিকের মারাত্মক খরা চলছে। আসলে জমিতে ফসল ফলাতে হলেও জমির ন্যূনতম উর্বরা শক্তি থাকতে হয় তেমনি উন্নত মানের কবি সাহিত্যিক হতে হলেও দেশে ন্যূনতম মুক্ত একটি পরিবেশ লাগে। আজ এমন একটি গুমট অবস্থা বিরাজ করছে কোন কিছুর সমালোচনা করা যায় না। ধর্ম নিয়ে লিখতে গেলে কলম থেমে আসে, রাজনীতি নিয়ে লিখতে গেলে কলম আর বলতে গেলে কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে। এইরকম একটি পরিবেশে কবি যদি আজ বাংলাদেশে জন্মাতেন আমি শতভাগ নিশ্চিত আজকে আমরা যেই নজরুলকে চিনি তার শতভাগের একভাগও হতে পারতেন না।
তাকে কোন একটি দলের হয়ে যেতে হতো, তোষামোদি করতে হতো। দলান্ধ, ধর্মান্ধ আর চাটুকার হয়ে সৃষ্টিশীল কেউ হওয়া যায় না। এই গুমোট পরিবেশেও যদি উনি লিখে যেতেন বা বলতে থাকতেন তাহলে তাকে হয় জেলে থাকতে হতো না হয় গুম খুনের শিকার হতে হতো। যেটি হয় সরকার করতো না হয় কোন ধর্মান্ধ গুষ্টি করতো। তখন ভারতবর্ষের মানুষ কত সেক্যুলার ছিল সেটা বোঝার জন্য কবির চিকিৎসার জন্য যারা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের লিস্টটা একটু দেখবেন।
কবির লেখা আমার প্রিয় একটি কবিতার কিছু অংশ শেয়ার করে লেখাটি শেষ করছি।
” মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান্।
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।”
“ভুখারী ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে-
‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা ব’লে বন্ধ করনি প্রভু।
তব মস্জিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী।
মোল্লা-পুরত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!”


কামরুল হাসান মামুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়








































আপনার মতামত লিখুন :