আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।
– অনুচ্ছেদ ৩২, সংবিধান ১৯৭২
… প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোন ব্যক্তি বা অন্য কোন ব্যক্তি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রয়োজনে কিংবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যে কোন অঞ্চলে শৃঙ্খলা-রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে কোন কার্য করিয়া থাকিলে সংসদ আইনের দ্বারা সেই ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করিতে পারিবেন কিংবা ঐ অঞ্চলে প্রদত্ত কোন দণ্ডাদেশ, দণ্ড বা বাজেয়াপ্তির আদেশকে কিংবা অন্য কোন কার্যকে বৈধ করিয়া লইতে পারিবেন।
– অনুচ্ছেদ ৪৬, সংবিধান ১৯৭২
ক্রসফায়ার নিয়ে খুব আলোচনা চলছে। ক্রসফায়ার, গুম, খুন, বিনা বিচারে মাসের পর মাস জেলে আটক, বাংলাদেশে কোন নতুন ঘটনা নয়। ঘটনা নতুন না হলেও চেক পোষ্টে কথিত তল্লাসির নামে একজন অবসর প্রাপ্ত আর্মি অফিসার খুন হওয়া ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। আলোচনায় উঠে এসেছে ক্রস ফায়ার। আলোচিত এই ঘটনায় নতুনত্ব এই যে – এখানে খুন হওয়া মানুষটি কোন রাজনৈতিক দলের নেতা নয়। যে বা যাদের দ্বারা ক্রস ফায়ার সংগঠিত হবার কথা, তাদের চেয়ে ক্ষমতাধর মানুষ শিকার হচ্ছে বিচার বহির্ভূত খুনের।
নেতা মানেই অনৈতিক সুবিধা ভোগী, সাধারণ মানুষের চোখে। রাজনীতি মানেই ক্ষমতার আস্ফালন, ভিন্ন মাত্রা, অনৈতিকতা, লুটপাট। সুতরাং রাজনৈতিক নেতা ক্রসফায়ারে মারা গেলেও মানুষের মনে তেমন কোন প্রভাব ফেলে না। মানুষ জানে, বোঝে – কোন ঘটনা রাজনীতি মুক্ত না। তারপরও ‘আমি রাজনীতি করিনা’ বলতে গর্ব বোধ করে। শান্তি পায়। তৃপ্তি পায়। দেশের সবখানে আলোচনা চলছে পুলিশ কর্তৃক অবসর প্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার খুন হওয়া নিয়ে।
বর্তমানে – ভিন্ন মতের রাজনীতি মানেই শত্রুপক্ষ, ক্ষমতাসীনদের কাছে।
মুক্তি যুদ্ধের বাংলাদেশে প্রথম বিচার বহির্ভূত হত্যা কাণ্ড ঘটে – স্বাধীনতার অল্প সময় পরে। ভিন্ন মতের রাজনীতি করবার কারণেই সিরাজ সিকদার কে হত্যা করা হয় বিনা বিচারে।
সামরিক বাহিনীর একজন অবসর প্রাপ্ত অফিসার আধা সামরিক বাহিনীর হাতে খুন হবার পর দেশের জনগণ বিভক্ত হয়েছে দুই ভাগে। অধিকাংশের অবস্থান অবসর প্রাপ্ত সেনা অফিসারের পক্ষে এবং খুব কম সংখ্যক মানুষ পুলিশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
আর্মি মানেই সহি মানুষ? এমন এক বদ্ধমূল ধারনা মানুষের মনে জন্মাল কি করে এবং কেন? সেটি কিন্তু ভাববার বিষয়। বাংলাদেশে যে দু’বার সামরিক শাসন এসেছে সেই দু’বারই কিন্তু সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করেই আর্মি অফিসারগণ ক্ষমতায় এসেছে। প্রথম বার জিয়াউর রাহমানের হাত ধরে, দ্বিতীয় বার হুসাইন মোঃ এরশাদ এর হাত ধরে। এখনও মানুষ এরশাদের নাম উচ্চারণ করলে নামের সামনে বা পেছনে স্বৈরাচার কথাটি লাগাতে ভুল করে না। অনেক ক্ষত্রেই মানুষ ‘ক্রসফায়ার’ এর পক্ষে অবস্থান নিলেও এই ঘটনায় একজন অবসর প্রাপ্ত আর্মি অফিসারের পক্ষ নিয়ে মানুষ পুলিশকে গালি দিচ্ছে কেন? জনগণ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে কেন ‘ক্রসফায়ারের’ বিপক্ষে অবস্থান না নিয়ে অবস্থান নিচ্ছে সেনা অফিসারের পক্ষে পুলিশের বিপক্ষে?
সেনা সদস্য মানেই যে ‘ধোয়া তুলশী পাতা’ নয়, জনগণ তা জানে খুব ভালভাবেই। তবে সেনা বাহিনীর প্রতি জনগণের এই সমর্থনের পেছনের কারণ কি? গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে লুটপাট-কারীরা তাদের অর্থ সম্পদ ফেলে দিয়ে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করেছিল বলে?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার মূলতই সেনা সমর্থিত সরকার। যে সরকারের মেয়াদ ৯০ দিন। এবং তাদের কাজ – নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিন তো দুরের কথা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিল দীর্ঘ দিন!। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নির্মূল করার অভিপ্রায়ে আবির্ভাব ঘটিয়েছিল মাইনাস টু ফরমুলার। তারপরও আর্মির পক্ষ নিয়ে কথা বলাদের দলে – আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও জামাতের সমর্থক সহ সাধারণ মানুষ! কেন এতো বেশী আস্থা সেনাবাহিনীর উপর?
রাস্তায় দামী দামী গাড়ি ফেলে, টাকা পয়সা ফেলে মানুষ খুব শৃঙ্খলার ভিতর দিয়ে চলেছিল অল্প কিছু দিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম দিকে। সে জন্যই কি তারা আর্মিকে দেবতা ভাবছে? যে ভাবেই হোক সাধারণ মানুষের নিত্য দিন পাশে দাঁড়ায় পুলিশ, আর্মি নয়!
তবে কি সেই সকল কথা ভুলে চাঁদাবাজি, গুম, ধর্ষণ, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সহ বেপরোয়া দুর্নীতির জাঁতাকলে পৃষ্ট হয়ে আশ্রয় চাইছে সামরিক বাহিনীর কাছে? উন্নয়নের গণতন্ত্রে দিশেহারা হয়ে কি মানুষ খুঁজছে আবার সেনা শাসন?
২০১৪ ও ২০১৮ এর মধ্যরাতের নির্বাচন দুষছে মানুষ। পুলিশ বাহিনীর এই বেপরোয়া ভাবের কারণ এই যে- তারাই নাকি সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে ২০১৪ ও ২০১৮ তে। আসলেই কি ঘটনা তাই? সরকারের অন্য সকল প্রতিষ্ঠান কি পুলিশের সাথে যৌথ ভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করে নাই? কেবল মাত্র পুলিশের পক্ষেই কি সম্ভব হয়েছে এমন ঘটনা ঘটানো?
২০১৪ ও ২০১৮ সালে ক্ষমতার লড়াইয়ে পুলিশকে ব্যবহার করেছিল বলেই কি পুলিশ এমন দানব হয়ে উঠেছে? নাকি পুলিশের হাতে যে কোন মিশাইলের চেয়ে শক্তিশালী ‘ক্রসফায়ার’ আইনি রক্ষা কবচ আছে বলেই সে দানব হয়ে উঠেছে?
পুলিশ কি ইচ্ছা করলেই ‘ক্রসফায়ার’ দিয়ে খুন করতে পারে? নাকি পুলিশকে এই খুন করতে হয় কারো হুকুমে? কে এই হুকুম দাতা? একজন মানুষ অন্য মানুষকে খুন করলে খুনি হয়, কিন্তু পুলিশ খুন করলে খুনি হয় না কেন?
পুলিশ যদি তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করে থাকে, তবে তারা তা করছে ‘ক্রস ফায়ার’ নামক আইন এর ক্ষমতায় ক্ষমতাসীন হয়েই। পুলিশই ‘ক্রসফায়ার’ কার্যকরী করার দায়িত্বে নিয়োজিত। পরিচালনাকারী। ‘ক্রসফায়ার’ কার্যকরীর কর্তা যখন পুলিশ, তখন পুলিশকে অবৈধ ক্ষমতার ব্যবহারকারী বলে অভিযুক্ত করবার কোন পথ কি আদৌ খোলা থাকে?
কে খুনি?
পুলিশ নাকি যে আইনি ক্ষমতা বলে পুলিশ খুন করে সেই ‘ক্রসফায়ার’?
কে খুনি?
‘ক্রসফায়ার’ বিচার বহির্ভূত খুন নাকি ‘ক্রসফায়ার’ অনুমোদনকারী রাষ্ট্র?
আদীল এ হোসেন
ঢাকা
2021-01-30 06:29:31
আপনার মতামত লিখুন :