বিরোধপূর্ণ জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে গত চার মাস ধরে ভারতের বিরুদ্ধে চীনের ‘আগ্রাসী’ মনোভাব দেশটির সীমান্তের নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত এবং দেশটির অতীত অবস্থানের সাথে সুস্পষ্ট ব্যত্যয়। বিশেষজ্ঞরা এমনটিই মনে করছেন।
খবরে প্রকাশ, বেইজিং নানামুখী কৌশল গ্রহণ করেছে: ভারতের সাথে সীমান্তজুড়ে বিশাল সামরিক মহড়া চালানো, ভারতের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় পরিচালিত মিডিয়ায় প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় প্রকাশ এবং আগ্রাসী কূটনৈতিক অবস্থান।
ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড চায়না সেন্টারের পরিচালক রানা মিত্তর বলেন, চীন তার সীমান্তে চাপ অনুভব করছে।
এই ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিজ্ঞানী আনাদোলু অ্যাজেন্সিকে বলেন, চীন তার সীমান্ত এলাকা নিশ্চিত করতে চায়।
পাকিস্তান ছাড়াও চীন ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট বিরোধপূর্ণ জম্মু ও কাশ্মিরে ভারতের একতরফা দখলদারিত্বের প্রচণ্ড বিরোধিতা করে। সাবেক ওই রাজ্যটির মর্যাদা বাতিল করে ভারত সেটিকে জম্মু ও কাশ্মীর ইউনিয়ন টেরিটরি (ইউটি) ও লাদাখ ইউটিতে পরিণত করে।
লাদাখের সাথে চীনের সীমান্ত রয়েছে। চীন ও ভারতের মধ্যকার বর্তমান উত্তেজনা লাদাখে। এখানে দুই দেশের মধ্যকার সঙ্ঘাতে ভারতের ২০ সৈন্য নিহত হয়েছে।
এদিকে ১৯৭৫ সালের পর দুই দেশ প্রথমবারের মতো গুলিবর্ষণ করেছে। ঘটনাটি অচিহ্নিত এই সীমান্তে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার লঙ্ঘন।
চীনের পররাষ্ট্রবিষয়ক চিন্তাভাবনা ও নীতি প্রণয়নের ব্যাপারে ধারণা পাওয়া কঠিন ব্যাপার।
অবশ্য, বেইজিংভিত্তিক প্রভাবশালী একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক একই মাসে জানায় যে, চীনা সামরিক বাহিনীর হাতে ভারতীয়রা হতাহতের শিকার হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, চীনা এলাকা নিয়ে ভারত মানচিত্রে নতুন নতুন এলাকা যোগ করছে, জিয়ানজিয়ান ও তিব্বতের মধ্যে থাকা অনেক এলাকা নিজের করে নিয়েছে। এর ফলে কাশ্মীর বিরোধে চীন অন্তর্ভুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে, কাশ্মীর ইস্যু প্রশ্নে চীন ও পাকিস্তান ভূমিকা রাখতে উদ্দীপ্ত হয়েছে, চীন ও ভারতের মধ্যকার সীমান্ত ইস্যু নিরসন আরো কঠিন করে তুলেছে।
চীন কঠোর হতে যাচ্ছে
নয়া দিল্লী ভিত্তিক সাংবাদিক কল্লোল ভট্টাচার্য আনাদোলু এজেন্সিকে বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়া এলাকায় বেইজিং আরো কঠোর হবে। আর তা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ঐতিহ্যবাহী অবস্থানে দেশটিকে আরো চাপে রাখবে।
দি হিন্দু পত্রিকার ভারতের পররাষ্ট্র ইস্যুবিষয়ক সাংবাদিক ভট্টাচার্য বলেন, চীনের নতুন তিব্বত নীতির কারণে চীনের এমন অবস্থান গ্রহণই স্বাভাবিক।
চীনের তিব্বত ইস্যুর সাথে দালাই লামার উত্তরাধিকারকে সম্পর্কিত করে ভট্টাচার্য বলেন, চীনে কমিউনিস্ট ব্যবস্থা চালু থাকলেও দেশটি বৌদ্ধ বিশ্বের নেতা হতে চায়। এ কারণে দালাই লামার বিষয়টি সামনে থাকবেই। অন্তত দালাই লামার উত্তরসূরি কে হবেন, তা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে চীন।
তিনি বলেন, এটি চীনের আগের অবস্থান থেকে সরে আসার প্রয়াস।
১৪তম দালাই লামা হচ্ছেন তেনজিন গিয়াতসো। তিনি তিব্বতি বৌদ্ধবাদের নবনতম স্কুল গেলগ স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ সন্ন্যাসী।
তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা বিবেচিত হয়ে তিনি ১৯৫০-এর দশকে অঞ্চলটি ত্যাগ করেন এবং উত্তর ভারতের ধর্মশালায় বসবাস করতে থাকেন। তিনি এখানে প্রবাসী তিব্বতিদের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখেন। ভারত ও চীনের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এটিও একটি বিরোধপূর্ণ বিষয়।
তিনি বলেন, ভারতের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ ইস্যু আছে। অর্থনীতি নজিরবিহীন অবস্থায় নেমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র অভ্যন্তরীণভাবে বিভক্ত। তাছাড়া এখন দেশটির নির্বাচনী বছর। আর চীনের সাথে তাল মেলাতে পারবে না ইউরোপ। অন্য দিকে আফ্রিকা, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, ল্যাতিন আমেরিকা- সব দেশই চায় বিনিয়োগকারী এবং চীন এসব দেশে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, চীনের অনেক আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম আছে, বিশেষ করে জাতিঙ্ঘ ও এর বিভিন্ন সংস্থায়। বিষয়টি নতুন। আমাদেরকে নতুন চীনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
মিত্তরের মতে, বিদেশে চাপে থাকলেও চীন কিছু কিছু এলাকায় নিশ্চিত অবস্থানে আছে: তাদের অর্থনীতি আবার বিকশিত হচ্ছে, যদিও ধীরে ধীরে, বেশ দ্রুততার সাথে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে।
সিপিইসির নিরাপত্তা সর্বোচ্চ
চীন ঘোষণা করেছে যে ৬০ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরটি (সিপিইসি) তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প। উত্তর পাকিস্তান দিয়ে আরব সাগরের বালুচিস্তান পর্যন্ত যাওয়া এই প্রকল্প নিয়ে চীনের উদ্বেগ রয়েছে।
চীন এখন পর্যন্ত এই এলাকা নিয়ে কোনো সমাধান পায়নি। এটি নিয়ে চীন স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন।
পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকা গিলগিট-বাল্টিস্তানকে নিজের দাবি করে ভারত। ফলে তারা এখান দিয়ে সিপিইসি অতিক্রম করায় এর বিরোধিতা করছে।
তিনি বলেন, এই এলাকায় চীন তার সীমান্ত নিয়ে চাপের মুখে আছে। এ কারণ সে তার সীমান্ত নিশ্চিত করতে চাইছে।
তবে পাকিস্তানি কূটনীতিক আব্দুল বাসিত আশঙ্কা করছেন যে চীনের সিপিইসি ইস্যুটি কাশ্মীর প্রশ্নে ইসলামাবাদের প্রতি বেইজিংয়ের সমর্থনকে দুর্বল করে তুলবে।
ভারতে নিযুক্ত সাবেক পাকিস্তানি এই হাই কমিশনার আনাদোলুকে বলেন, ভারত ও চীনের পারস্পরিক স্বার্থ হলো, এটি নির্দিষ্ট অবস্থার পর উত্তেজনা না বাড়ানো। চীন চায় ভারত যেন সিপিইসিতে অন্তর্ঘাত না চালায়। এর বিনিময়ে চীন কাশ্মীর ইস্যুতে তার অবস্থান নমনীয় করতে পারে।
2021-05-04 18:24:24
আপনার মতামত লিখুন :