২৯ আগস্ট, পবিত্র মোহাররম মাসের ১০ তারিখ। দিনটি আশুরা নামে পরিচিত। ভারত-শাসিত কাশ্মীরে ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় মিছিলে অংশগ্রহণরত শত শত শিয়া মুসলিমকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য ভারতীয় বাহিনী পেলেট আর কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। একে বেশ কয়েকজন লোক মারাত্মকভাবে আহত হয়।
নিরাপত্তা বাহিনী কাঁদানে গ্যাস আর পেলেট ব্যবহার করে শ্রীনগরের জাদিবাল এলাকায় শিয়া শোক প্রকাশকারীদের অবরুদ্ধ করে, তাদেরকে আবাসিক কম্পউন্ডগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়। পেলেটবিদ্ধ একটি শিশুকে আমি যন্ত্রণায় মাটিতে কাতরাতে দেখেছি। আরো অনেকে কাঁদানে গ্যাসের মেঘে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। ফলে শ্বাস নিয়ে কষ্টে থাকা লোকজনকে সরিয়ে নেয়ার কাজটিও হয়ে পড়ে কঠিন।
পরে কর্মকর্তারা জানায়, মোহররম শোভাযাত্রায় অংশ নেয়ায় অন্তত ২০০ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের অন্তত সাতজনকে ভারতবিরোধী স্লোগান দেয়ার কারণে কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে।
চলতি বছরের মোহাররম শোভাযাত্রা দমন করার ভারতীয় রাষ্ট্রের এ ধরনের শক্তির ব্যবহার হলো উপত্যকার স্বাধীনতা ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের প্রতি কাশ্মীরী শিয়াদের সমর্থন নিয়ে ভারতের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের ইঙ্গিত।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ দিন ধরে বলে আসছিল যে ভারত-শাসিত কাশ্মীরের সুন্নি-নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতাপন্থী আন্দোলনকে শিয়া এবং ওই অঞ্চলের অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এড়িয়ে চলছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবশ্য তরুণ শিয়া নারী ও পুরুষ ক্রমবর্ধমান হারে রাজনৈতিক অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে ওঠেছে, তাদের অনেকে তাদের আবাসভূমিতে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে শুরু করেছে।
কয়েক দশক ধরে কাশ্মীরের শিয়ারা হজরত মোহাম্মদের (সা.) নাতি ইমাম হোসেনের মৃত্যুর স্মরণে আশুরা পালন করে আসছিল। তাদের প্রধান শোভাযাত্রাটি হতো শ্রীনগর সিটিতে প্রায় ৯ কিলোমিটার রাস্তায়। অবশ্য, ১৯৯০-এর দশকে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের সময় এই শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ হয়।
তারপর থেকে শিয়াদেরকে নগরীর শিয়া এলাকায় কেবল মোহাররমের শোভাযাত্রা বের করতে দেয়া হয়। শিয়ারা আগের মতো শহরের কেন্দ্রস্থলে শোভাযাত্রা করার অনুমতি চাইলেও তা দেয়া হয়নি।
এর পর থেকে শিয়াদের কেউ কেউ ভারত রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার চেষ্টা করলেও তাতে সফল হয়নি। তবে ভারত রাষ্ট্র এই সীমিত প্রতিরোধকে তেমন আমল না দিয়ে এই বিশ্বাসে থাকে যে কাশ্মীরের শিয়া সম্প্রদায় তাদের শাসনের প্রতি কোনো হুমকি নয়।
অবশ্য, তারা ২০১৮ সালে লক্ষ করে যে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু করেছে।
শ্রীনগরের একটি মোহাররমের শোভাযাত্রায় তরুণ, জনপ্রিয় সুন্নি বিদ্রোহী কমান্ডার বুরহান ওয়ানির একটি পোস্টার দেখা যায়। এতে ভারত সরকার ও নিরাপত্তা সার্ভিসগুলো চিন্তিত হয়ে ওঠে। ভারতীয় সৈন্যরা ২০১৬ সালের এক এনকাউন্টারে বুরহান ওয়ানিকে হত্যা করে। এর জের ধরে কয়েক মাস ধরে কাশ্মীরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়।
শিয়া তরুণদের একটি অংশের কাছে মোহাররম শোভাযাত্রায় ওয়ানির মতো এক সুন্নি বিদ্রোহীর প্রশংসা নজিরবিহীন। এ ধরনের শোভাযাত্রায় আমি সারা জীবন নিয়মিত অংশ নিয়েছি। কিন্তু কখনো এ ধরনের কিছু আগে দেখিনি।
মোহাররমের শোভাযাত্রায় ওয়ানির চেহারা দেখা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের জন্য ছিল কষ্টকর। কিন্তু শিয়া তরুণদের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি সমর্থন কিছু দিন ধরে বাড়ছে।
সন্দেহ নেই যে কাশ্মীরী সংগ্রামে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে মুসলিমরা। আর তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক হচ্ছে সুন্নি। কিন্তু শিয়ারা সবসময়ই কাশ্মীরী সংগ্রামে কিছু ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৩০-এর দশকে শিয়া নেতারা ডোগরা শাসকদের বিরুদ্ধে রাজতন্ত্রবিরোধী সংগ্রামে সুন্নি নেতাদের পাশে ছিলেন।
ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৪৭-পরবর্তী, বিশেষ করে ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে, রাজনৈতিক ও উগ্র অবস্থানে কাশ্মীরী শিয়ারা নেতৃত্বদানকারী ভূমিকায় ছিল। কারণ ওই সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের ওপর দমন অভিযান চালানো হয়েছিল।
১৯৯০-এর দশকে হিজবে-মুমিনিনের মতো শিয়া গ্রুপগুলো সুন্নি-প্রাধান্যপূর্ণ সশস্ত্র বিদ্রোহে যোগ দেয়।
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে প্রতিবেশী পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণে কাশ্মীরী শিয়ারা প্রভাবিত হয়। তারা কাশ্মীরের রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করে। তবে ২০০০-এর দশকের প্রথম দিকে সশস্ত্র বিদ্রোহে তাদের সম্পৃক্ততা ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়।
তাছাড়া, স্বাধীনতাপন্থী নেতাদের বয়কটের আহ্বান সত্ত্বেও কয়েকজন শিয়া ধর্মীয় নেতা রাজ্য নির্বাচনে অংশ নেন। শিয়া এলাকায় ব্যাপক ভোটার টার্নআউটে মনে হতে থাকে যে ওই আন্দোলনের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা নেই।
শিয়াদের কেন এখন কাশ্মীরী আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক বেশি বেশি দেখা যাচ্ছে, তার কয়েকটি কারণ রয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে কাশ্মীরের শিয়া তরুণরা তাদের অবস্থান প্রকাশ করছে, রাজ্যের পরিস্থিতি ও নির্যাতন বাড়ায় তারা রাজনীতিতে সরব হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত বছর ভারত জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন মর্যাদা বাতিল করে দেয়। এটি শিয়াদের ক্ষুব্ধ করেছে। এমনকি যে লাদাখের শিয়ারা সবসময় স্বাধীনতাপন্থী আন্দোলন থেকে দূরে থেকেছে, তারাও স্বায়ত্তশাসন মর্যাদা বাতিলের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে।
ইরাকের ইসলামিক স্টেটের হামলা, কাশ্মীরে বিভাজন সৃষ্টির ভারতীয় প্রয়াসের কারণে কাশ্মীরী শিয়াদের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। এর ওপর ভিত্তি করে ভারতীয়রা দাবি করত যে শিয়ারা কাশ্মীরের রাজনৈতিক সংগ্রামকে সমর্থন করে না।
কিন্তু ক্রমবর্ধমান রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও সহিংসতার কারণে তরুণ শিয়ারা এখন কাশ্মীরী সংগ্রামে নিজস্ব ভাষ্য ও অবস্থান নির্মাণের প্রয়াস চালাচ্ছে। যে মোহাররম শোভাযাত্রা শিয়াদের ন্যায়বিচার, সম্মান ও প্রতিরোধের গুরুত্ব তুলে ধরে, সেটিই তাদের হাতে থাকা সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
ভারতের ডানপন্থী, হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার অব্যাহতভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের জনসংখ্যাগত বিন্যাস পরিবর্তনের চেষ্টা করতে থাকায় স্বাধীনতার জন্য শিয়াদের কণ্ঠ উচ্চকিত হচ্ছে এখন। কয়েক দশক ধরে ভারত মোহাররমের শোভাযাত্রা করতে দেয়ার দাবিকে গ্রাহ্য করেনি।
আর রাষ্ট্রযন্ত্রের শিয়ারা ভারতপন্থী ও স্বাধীনতাবিরোধী বলে প্রচারণা করে আসছিল, তা আর টিকছে না। কাশ্মীরের মুসলিম সম্প্রদায়গুলোর মধ্যকার দূরত্ব এখন কমে আছে। আর শিয়ারা ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার ডাক দিচ্ছে।
2021-05-04 20:20:27
আপনার মতামত লিখুন :