আফগানিস্তানকে নিয়ে ভারতের স্বপ্নভঙ্গ


অনলাইন ডেক্স প্রকাশের সময় : মে ৪, ২০২১, ৯:২৩ অপরাহ্ন
আফগানিস্তানকে নিয়ে ভারতের স্বপ্নভঙ্গ

২০০১ সালে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধ শুরু হলে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে কান্দাহারের একটি এলাকায় তালেবানদের হাতে বন্দি হয়েছিলাম। আমাকে বেশি সময় সেই বন্দিত্ব সহ্য করতে হয়নি। তারা যখন নিশ্চিত হয়েছিলেন আমি সাংবাদিক এবং বাংলাদেশি তখন তালেবানদের এক কমান্ডার গাড়ি চালিয়ে পাকিস্তান-আফগান সীমান্তবর্তী বালুচিস্থানের ছোট্ট একটি শহর চামনের এক হোটেলে রেখে গিয়েছিলেন আমাকে।

আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে ও তালেবানদের সমর্থনে তখন বাংলাদেশে মিছিল হচ্ছে, এমন একটি ছবি একজন তালেবান সদস্য সেসময় পাকিস্তানের কোন পত্রিকায় দেখেছে। সেটি আমাকে তাদের সহানুভূতি লাভে খুব কাজে দিয়েছিল। মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেও এই ঘটনা আমাকে একটি অভিজ্ঞতা দিয়েছে—জীবন এবং মৃত্যুর মাঝামাঝি পরিস্থিতিতে একজন মানুষের অনুভূতি কেমন হয় সেটি জানার। আমি অনেককে বলেছি—২০০৩ সালের মার্চে ইরাক যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহ করতে বাগদাদ যাওয়ার সাহসটা আমি আসলে সেই ঘটনা থেকেই পেয়েছিলাম।

যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান দেখার জন্য ঠিক এক বছর পর আমি যখন আবার কাবুল যাই, সেখানে মুখোমুখি হতে হয়েছে ভিন্ন অভিজ্ঞতার। আমি ইসলামাবাদ থেকে আরিয়ানা নামে আফগানিস্তানের জাতীয় এয়ারলাইন্সের ছোট্ট একটি উড়োজাহাজে যখন কাবুল যাচ্ছিলাম পাকিস্তানি সাংবাদিক বন্ধুরা তখনই আমাকে সতর্ক করেছিল। যাওয়ার দ্বিতীয় দিনে কাবুলের কেন্দ্রস্থলে একটি জনবহুল রাস্তায় আমাকে আটক করে কিছু লোক। তারা সবাই তালেবানদের প্রতিপক্ষ—নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের সমর্থক। ক্ষমতা বদলের পর ওরাই তখন কাবুলের পাহারাদার।

তারা বলছে আমি পাকিস্তানি, কাবুলে কেন এসেছি। উর্দুতে কথা বলছিল। আমি কথাবার্তা চালানোর মতো হিন্দি-উর্দু মিশ্রিত একটা খিচুড়ি ভাষা জানি, কিন্তু ভুলেও তা বলছি না তখন। কারণ ইসলামাবাদে সাংবাদিক বন্ধুরা আমাকে যেভাবে সতর্ক করেছে, সেটা তখনও মনে আছে- কাবুলে পাকিস্তানি কাউকে পেলে তালেবান বিরোধিরা লাঞ্ছিত করে। উর্দু বলা মানেই পাকিস্তানি সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হওয়া।

কেউ কেউ প্রশ্ন করছে—হিন্দি, হিন্দি? মানে আমি ভারতীয় নাগরিক কিনা; ভারতীয় হলে আমাকে ছেড়ে দেবে। আমি সঙ্গে থাকা পাসপোর্ট দেখালাম, মূর্খরা তা চিনে না, পড়তেও পারে না। অনেক কষ্টে তাদের রাজি করাতে পারলাম যে নিকটস্থ কোনও পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাও আমাকে। তাই করলো এবং পুলিশ আমার পরিচয় পেয়ে সম্মানের সঙ্গে ছেড়ে দিলো।

এই কাহিনী বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে তালেবান পতনের পর আফিগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর দখলদারিত্বে ভারতীয়দের আধিপত্য বুঝানোর জন্য। আফগান যুদ্ধে পারভেজ মোশাররফ নামেমাত্র তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে থাকলেও যুদ্ধের পর পাকিস্তান হয়ে যায় আফগানিস্তানের শত্রু রাষ্ট্র। ভারত হয় বন্ধু রাষ্ট্র।

কাবুল সরকারের সহায়তা পেয়ে ভারত সেখানে ব্যবসা বাণিজ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং পাকিস্তানবিরোধী একটা পরিবেশ তৈরি করে, যা পরবর্তী এক যুগ ছিল বলা যায়। দুই প্রতিবেশী পাকিস্তান ও আফগানিস্তান নানা ঝগড়া বিবাধ, নরম-গরম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তান নির্ভরতা কাটাতে কাবুল সরকার ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তবে এতে না হয়েছে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক কল্যাণ, না এসেছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।

অন্যদিকে, সরকারি নীতি যাই হোক, তালেবানদের সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর যোগাযোগ বরাবরই ছিল। তালেবানদের অবাধ যাতায়াত ছিল পাকিস্তানে। মোল্লা ওমরের তালেবান সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতা হারিয়েও বছরের পর বছর দখলে রেখেছে দেশের বিস্তৃত এলাকা, এরপর ১৯ বছর ধরে চলছে সেই যুদ্ধ। আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী ও সরকারি বাহিনী—দুটির সঙ্গে লড়ে গিয়েছে তালেবান। এতে প্রায় ২৩০০ বিদেশী সৈন্য নিহত হয়েছে, আহতদের সংখ্যা ২১ হাজার। আর আফগান সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর ৫৮ হাজার সদস্য প্রাণ হারিয়েছে। মার্কিনিদের আর্থিক ব্যয় দুই ট্রিলিয়ন ডলার।

সর্বশেষ ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবানদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে আমেরিকা। এতে ২০২১ সালের মাঝামাঝি নাগাদ সব মার্কিন সেনাকে দেশে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু সেই চুক্তি কার্যকরে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বন্দিমুক্তি। তালেবানদের শর্তানুয়ায়ী ৫,০০০ বন্দির সবাইকে মুক্তি দিতে অস্বীকার করে কাবুল। তালেবানরাও হামলা বন্ধ করেনি কথা মতো।

অবশেষে এগিয়ে আসে চীন। তারা কাবুল সরকার, তালেবান আর পাকিস্তানকে এক মঞ্চে আনতে নেপথ্য ভূমিকা রাখে। গত ২৬ আগস্ট ২০২০ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি আফগানিস্তানে নিয়োজিত চীনের বিশেষ দূত লিউ জিয়ানকে প্রায় দুই দশক ধরে চলা আফগান যুদ্ধ অবসানে সাহায্য করার জন্য ইসলামাবাদে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে তালেবানদের রাজনৈতিক শাখার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের বৈঠক হয় কীভাবে তালেবান এবং আফগান সরকার একটা সমঝোতায় পৌঁছতে পারে তার রূপরেখা নিয়ে।

আফগানিস্তানে চীন-পাকিস্তানের এই উপস্থিতি ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যের উচ্চাভিলাষকে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। চীন শুধু অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে নেপাল, বাংলাদেশকেই নিজের দিকে টানতে চাইছে না, আফগানিস্তানের জন্যও তাদের বড় উন্নয়ন প্যাকেজ রয়েছে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও তালেবানদের এক মঞ্চে এনে তারা সেটা দেখিয়েও দিয়েছে।

সময়ের ব্যবধানে তালেবানরা বিশ্বকে বুঝাতে পেরেছে আফগানিস্তানের উন্নয়ন, গঠন ও শান্তি প্রক্রিয়া থেকে তাদেরকে বাদ দেওয়া সম্ভব না। প্রতিবেশী ইরান, চীন, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া, পাকিস্তান সবাই একমত যে জাতি গঠনে তালেবানদের ভবিষ্যৎ ভূমিকা রয়েছে। এটাকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সেখানে ভারতের কূটনীতি এবং ভূমিকা চরম ব্যর্থ হয়েছে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুরেশির সঙ্গে তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গণি বারদারের নেতৃত্বে একটি তালেবান প্রতিনিধি দলের বৈঠকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই প্রধানও ছিলেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাম না নিয়ে ভারতের উদ্দেশে বলেন, তারা আফগান শান্তি আলোচনার অগ্রগতি চায় না। তালেবান নেতা বারদার ৮ বছরের বেশি সময় ধরে পাকিস্তানের নিরাপত্তা হেফাজতে ছিলেন বলা হয়। ২০১৮ সালে তাকে ছাড়া হয় সম্ভবত তালেবানদের সঙ্গে চীনের বৈঠকের মঞ্চ তৈরির জন্য।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকার করেছেন তারা সরে গেলে কাবুলের পশ্চিমা সমর্থিত সরকারকে হটিয়ে তালেবানরা রাজধানী কাবুলের দখল করে নিতে পারে। কাবুল সরকারের জন্য এখন আশা হচ্ছে আসন্ন আন্তঃআফগান বৈঠক সফল করা, যেখানে সম্ভবত তালেবানের প্রায় সব শর্তই মেনে নেওয়া হবে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তির ট্যামপ্লেটের চেয়ে খুব আলাদা নয়।

প্রতি মাসেই আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীর ডজন ডজন সদস্য পক্ষ ত্যাগ করে তালেবান বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে। মার্কিনিদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সই হওয়ার পর এই প্রবণতা আরও বেড়ে গেছে। বড় পদবির কর্মকর্তারাও যোগ দিচ্ছেন। তালেবানদের সঙ্গে চুক্তির সময় মার্কিন সেনাবাহিনীর আকার প্রায় ১৩ হাজার থেকে ৮,৬০০ তে নেমে এসেছিল। ট্রাম্প এই আগস্টের শুরুর দিকে বলেছিলেন যে নভেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে আফগানিস্তান থেকে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার সেনা প্রত্যহার করা হবে।

এই চুক্তিতে তালেবানের হাতে বন্দি থাকা ১,০০০ আফগান সরকারি বাহিনীর সদস্যকেও মুক্তি দানের কথা বলা হয়েছিল। এপ্রিল মাসে পাল্টাপাল্টি মুক্তিদান শুরু হওয়ার পর থেকে তালেবানরা পর্যায়ক্রমে সব বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে, কাবুল সরকার খুবই অল্প সংখ্যক ছাড়া বাকিদের মুক্তি দেয়। এদেরকেও মুক্তি দেয়া হবে ভিন্ন প্রক্রিয়ায়। শুনা যাচ্ছে, এসব তালেবান বন্দিকে কাতারের দোহায় নিয়ে গিয়ে গৃহবন্দী করে রাখ হবে। এতে দুই পক্ষেরই মুখরক্ষা হবে। এখন আন্ত:আফগান আলোচনা শুরুর পালা।

ভারত বিজয়ের পর ব্রিটিশরা আফগানিস্তানের দখল নিতে বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ছিল। গত শতাব্দীর আশির দশকে সোভিয়েত রাশিয়াও পারেনি আফগানিস্তান দখলে রাখতে। এমন দৃষ্টান্ত সামনে থাকার পরও আমেরিকা ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে আল-কায়েদার সন্ত্রাসী হামলার পর আফগানিস্তান আক্রমণ করে বসে। কারণ তখন কাবুলে ক্ষমতায় ছিল তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের সরকার, যারা ওসামা বিন লাদেন ও তার সংগঠন আল-কায়েদাকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছিল।

তবে, আসন্ন আন্তঃআফগান আলোচনায় ১৯ বছরের যুদ্ধ অবসান হবে নাকি আরও রক্তক্ষয় অপেক্ষা করছে তার ফয়সালা হয়ে যাবে ধারণা করছি।

আনিস আলমগীর
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

2021-05-04 21:23:09

ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন: