চীনের প্রধান কয়লা সরবরাহকারী অস্ট্রেলিয়ার সাথে দ্বন্দ্বের পর পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় কয়লাক্ষেত্রে কাজের গতি বাড়িয়েছে বেইজিং। পাকিস্তানের নিজস্ব বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের জন্য এই কয়লা ব্যবহারের কথা থাকলেও কিছু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিকল্প উৎস হিসেবে চীনও এখান থেকে সুবিধা পেতে পারে।
কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে বেশ কয়েক মাস দেরির পর সাংহাই ইলেকট্রিক পাওয়ারের পাঁচশ’র মতো কর্মী চলতি মাসের শুরুর দিকে পাকিস্তানে পৌঁছেছে। পাকিস্তানের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের থারপারকার অঞ্চলের থার ব্লক-থ্রি সমন্বিত কয়লা খনি ও বিদ্যুৎ প্রকল্পে কাজ করবেন তারা।
চীনের মালিকানাধীন এই প্রকল্পটি ৫০ বিলিয়ন ডলারের চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের (সিপিইসি) একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে খোলা পিট মাইন যেটা সাথের ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের জন্য বছরে ৬.৮ মিলিয়ন টন লিগনাইট সরবরাহ করতে পারবে।
২০১১ সালে থার ব্লক-ওয়ান কয়লাক্ষেত্রেটি ৩০ বছরের জন্য চীনা কোম্পানি সিনো-সিন্ধ রিসোর্সেসের কাছে লিজ দেয়া হয়। এটা এখন সাংহাই ইলেকট্রিকের অধীনে কাজ করছে।
এখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পাকিস্তানের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। প্রথম বিদ্যুৎ প্ল্যান্টটি উৎপাদন শুরু করবে ২০২২ সালের আগস্টে। দ্বিতীয়টি করবে পরের ফেব্রুয়ারিতে।
থার কয়লাক্ষেত্রটি ভারত সীমান্তের কাছে সিন্ধের মরুভূমিতে ৯০০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে আছে। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় এবং বিশ্বে সপ্তম বৃহত্তম কয়লাখনি এটি, যেখানে মজুদ রয়েছে প্রায় ১৭৫ বিলিয়ন টন। পাকিস্তানের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হলো পুরো থার কয়লাক্ষেত্রকে ১২টি ব্লকে ভাগ করে উন্নয়ন করা। চীনা সহায়তায় চারটির কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।
ভরা মওসুমে পাকিস্তানের যে ৩,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি রয়েছে, সেটা পূরণের জন্য এবং জ্বালানি আমদানির উপর নির্ভরতা কমানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে নিজস্ব বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট তৈরি করতে হবে। চীন সিপিইসির মাধ্যমে জল, কয়লা, সৌর ও বায়ুবিদ্যুতের মাধ্যমে এ ব্যাপারে সাহায্য করছে।
অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক দেয়াকিন ইউনিভার্সিটির ইন্সটিটিউট ফর সিটিজেনশিপ অ্যাণ্ড গ্লোবালাইজেশানের রিসার্চ ফেলো জাহিদ আহমেদ বলেন, পাকিস্তানের জন্য জ্বালানি খাতের উন্নয়ন করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ তারা শিল্পায়ন করতে চায় এবং বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে চায়।
এমন সময় থার ব্লক-ওয়ান প্রকল্পের গতি বাড়ানো হলো যখন অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে থার্মাল কয়লা আমদানি কমিয়ে এনেছে বেইজিং। চলতি বছরের শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ে স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানানোর পর দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক বিবাদ বেড়ে যায়।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় কয়লা ব্যবহারকারী চীন আমদানিকৃত কয়লার উপর থেকে নির্ভরতা কমাতে চাচ্ছে। জানা গেছে, বেইজিংয়ের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা সংস্থা ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট অ্যাণ্ড রিফর্ম কমিশন রাষ্ট্রায়ত্ব ইউটিলিটি কোম্পানিগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে যাতে তারা অস্ট্রেলিয়ান থার্মাল কয়লা না কিনে।
অনেকেই ভাবছেন চীন নতুন কয়লা সরবরাহকারী খুঁজছে কি না। তবে সিন্ধ প্রদেশের জ্বালানি মন্ত্রী ইমতিয়াজ শেখ বলেন যে, সাংহাই ইলেকট্রিক পাকিস্তানি কয়লা আমদানির কোন আগ্রহ দেখায়নি। তিনি বলেন, থার ব্লক-ওয়ান প্রকল্পের মূল্য ২.৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
থার ব্লক-টুতে কর্মরত পাকিস্তানি প্রাইভেট কোম্পানি সিন্ধ এনগ্রো কোল মাইনিংয়ের প্রধান নির্বাহী সাইয়েদ আবুল ফজল রিজভি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যাওয়ার বড় পরিসরে এখন আমরা কাজ করছি না। এই মুহূর্তে আমাদের মনোযোগ হলো পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো যাতে বিদেশী জ্বালানির উপর থেকে দেশের নির্ভরতা দূর হয়।
কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বাণিজ্য অংশীদারদের সাথে সম্পর্কের অবনতির কারণে এবং দক্ষিণ চীন সাগরে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে চীনের নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে হবে এবং সে কারণে পাকিস্তানী কয়লাক্ষেত্রে বিনিয়োগের ব্যাপারে তারা পিছিয়ে পড়তে পারে।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের এশিয়া কর্মসূচির ডেপুটি ডিরেক্টর মিশেল কুগেলম্যান বলেছেন যে, অর্থনৈতিক ও জ্বালানি স্বার্থ রক্ষার জন্য নিরাপদ জায়গাতে তৎপরতা বাড়ানোটা চীনের জন্য স্বাভাবিক, যেখানে অনেকগুলো দেশের সাথে তাদের উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
কুগেলম্যান বলেন, পাকিস্তান সম্ভবত চীনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। সে কারণে পাকিস্তানের দিকে ফেরাটাই তাদের জন্য স্বাভাবিক, যেহেতু পাকিস্তানি দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানি অবকাঠামো নিয়ে কাজ করেছে চীন। ভূপ্রকৃতি এবং ভূরাজনীতির কারণে পাকিস্তানকে সরবরাহ রুট ও কয়লা আমদানির ক্ষেত্র হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব দেয় চীন।
2021-05-04 22:53:58
আপনার মতামত লিখুন :